শক্তিপদ বেরা [প্রধান শিক্ষক, বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়]: আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর পূর্বে এক আগাগোড়া আধুনিক মনস্ক দার্শনিক, শিক্ষাবিদ,দয়ার সাগর পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেছিলেন অজ পাড়া-গাঁ বীরসিংহ গ্ৰামে। তিনি ছিলেন প্রকৃত সমাজ সংস্কারক। সারা বাংলা জুড়ে সমাজ সংস্কারের অঙ্গ হিসেবে যেমন বিধবাদের বিবাহের ব্যবস্থা করেছিলেন, বাল্যবিবাহ রোধ করেছিলেন, বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তেমনই শিক্ষার উন্নতি সাধনে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষার উন্নতি ছাড়া কুসংস্কার দূর হবে না, সমাজ কলুষমুক্ত হবে না। তিনি বলেছিলেন, “শিক্ষার উন্নতি ছাড়া জাতির উন্নতি হইতে পারে না”। শিক্ষাবিস্তারে ও শিক্ষার উন্নতি সাধনে তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেগুলির ব্যয় ভার নিজে বহন করেছেন, পুস্তক রচনা করেছেন, যার মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘বর্ণপরিচয়’ রচনা।
এই মহান শিক্ষাব্রতী পূণ্যশ্লোক প্রাত:স্মরণীয় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে,তাঁর প্রতি সম্মান জ্ঞাপনে তাঁরই জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে তাঁর নামাঙ্কিত ‘বীরসিংহ বিদ্যাসাগর কলেজ’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয়। বিদ্যাসাগরের ভাই ঈশানচন্দ্রের উত্তরাধিকারী রূপে ভগবতী বিদ্যালয় সংলগ্ন সম্পত্তি ও বাগানের মালিক হয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের ভ্রাতুষ্পুত্র পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি গ্রামে কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ওই সম্পত্তি দান করেন। জনসাধারণ ও কলেজের জন্য অর্থ ও শ্রম দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। বর্তমান নতুন ছাত্রাবাসের দক্ষিণ দিকে কলেজের জন্য মাটির দোতলা বাড়ি নির্মিত হয়। বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়ের তৎকালীন বিদ্যালয় প্রধান পার্বতীচরণ চক্রবর্তীর উৎসাহে এবং বিদ্যালয়ের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক শিক্ষাব্রতী অধ্যাপক ক্ষিতিশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে বীরসিংহে বিদ্যাসাগর কলেজ স্থাপিত হয়। ওই বছরই কলেজে পঠনপাঠন শুরু হয়। সেই সময় কলেজের ছাত্র ছিলেন গৌরহরি সিংহ, সনৎ সিংহরায়, বংশী মণ্ডল, রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। কলেজের সভাপতির পদে ছিলেন অধ্যাপক ক্ষিতিশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও সম্পাদক ছিলেন পার্বতীবাবু। দু’বছর চলার পরও সরকারি অনুমোদন না মেলায় কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। কী কারণে কলেজ সরকারি অনুমোদন পেল না তা আজও সবার অজ্ঞাত। তবে পার্বতীবাবুর চিঠি থেকে আভাস পাওয়া যায় ক্ষিতীশবাবুর একগুঁয়েমির জন্য এবং কমিউনিষ্ট প্রভাবহেতু পুলিশ রিপোর্ট খারাপ হওয়ায় কলেজ সরকারি অনুমোদন পায়নি। ১৯৫২ সালে কলেজটির অপমৃত্যু ঘটে।
কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাতা পরেশবাবুর দলিলের শর্তানুযায়ী ওই সম্পত্তি ভগবতী বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। কলেজ ভবনটি বিদ্যালয়ের আবাসিক, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হত। মাটির বাড়িটি ধূলিসাৎ হওয়ায় বর্তমানে কলেজের কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই। বর্তমানে বিদ্যালয়, বীরসিংহবাসী ও পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করা হয়েছে যাতে বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণতা দিতে ওই স্থানে বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত একটি মহিলা মহাবিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।