কাজলকান্তি কর্মকার[সাংবাদিক, ‘বর্তমান’ পত্রিকা•MWT:9933066200]: ডিজে বাজানোর বিরোধিতা করে কোনও খবর প্রকাশিত হলেই কিছু মানুষ মন্তব্য করেন, বছরে একটা দিন ডিজে বাজালে সমস্যা কোথায়? যাঁরা ডিজে বাজানোর পক্ষে সওয়াল করছেন তাঁরা কখনও খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে এলাকায় ডিজে বাজে সেই এলাকার কত শতাংশ মানুষ সেটাকে মন থেকে মেনে নেন? সেটা পুজোর ডিজেই হোক, রাজনৈতিক দলের প্রচার বা বিজয় মিছিলের ডিজেই হোক। দু’তিন শতাংশের মানুষের ‘বিশেষ’ অবস্থার উদ্দাম আনন্দের জন্য বাকি সমস্ত মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েন। আমার প্রশ্ন, আপনার আনন্দের বিষয়টি অন্যের বিরক্তির কারণ কেন হবে? বছরে একটা দিন কেন বছরে ৩৬৫টা দিন ডিজে বাজান তাতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু এমন জায়গায় ডিজে বাজান যার শব্দ অন্যদের বিন্দুমাত্র বিরক্ত না করে। কারণ, আনন্দটা একেবারে ব্যক্তিগত। আপনি আপনার মতো করে আনন্দ করতেই পারেন। সে অধিকার আপনার রয়েছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে আপনার আনন্দের প্রভাবে অন্যের যেন অস্বস্তি বা বিরক্তি না ঘটে। সেটা মাইক বাজানো হতে পারে, বাজি ফাটানো হতে পারে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সময়-অসময়ে উৎপন্ন উৎকট শব্দ হতে পারে, রাজনৈতিক দলের প্রচার হতে পারে—মোট কথা আপনার বা গুটি কয়েক জনের ভালোলাগার বিষয়টি জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা নিছক অভদ্রতা বা অসামাজিক আচরণের মধ্যেই পড়ে।
আমরা যারা ডিজে বাজানোর প্রকাশ্যে বিরোধিতা করি তারা নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘু। কারণ আমাদের প্রতিবাদ কখনই মাত্রা পায় না। পুলিশের সহযোগিতা করার ইচ্ছে থাকলেও তারা পারে না। আমাকে ঘাটাল মহকুমার এক সময়ের এক ওসি আক্ষেপ করে গল্প করেছিলেন, এলাকায় ডিজে চলার জন্য এক আইনজীবী রাত ১টার সময় ওসিকে ফোন করেছিলেন। ওসি সেই ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় গিয়েছিলেন ডিজে বন্ধ করতে। ডিজেও আটক করা শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই সময় এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ফোন, ওই ক্লাবের ডিজে যেন বন্ধ করা না হয়। পরিণাম খারাপ হবে। ওসিকে বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল। তাই পুলিশ বলে, ডিজে বন্ধ করতে একমাত্র জনপ্রতিনিধিরাই পারেন। যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা তাদের দলীয় কাজেও ডিজে ব্যবহার করেন তাই তাঁরাও মন থেকে ডিজে বন্ধ করতে চান না। সেজন্য সমাজের বেশিরভাগ মানুষ ডিজের উৎকট শব্দে জেরবার হলেও কিছু করতে পারেন না। আর পুলিশের কাছে ডিজে বন্ধের অভিযোগ গেলে তাদের নানা কারণ দেখাতে হয়। যে অভিজ্ঞতার কথা কিছুদিন আগে মেহেবুব আলাম আমার টাইমলাইনেই বলেছিলেন।
তাই আমরা ডিজে বন্ধের বিষয়ে যতই চিৎকার করি, গলা ফাটাই কাজের কাজ কিছু হবে না। কারণ যাঁরা ডিজে বাজানোর পক্ষে রয়েছেন যাঁরা সমর্থন করেন সেই ধরনের মানুষকে সমাজ সবসমই ভয় করে চলে। তাই গত রাতে ঘাটাল থানার মনশুকার মতো ঘটনা প্রত্যেকদিন ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর পলাশবাবুর মতো ঘটনা ঘটলে হয়তো ডিজে বাজানো চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দাসপুর থানা এলাকার বাসিন্দা পলাশ মাইতি কিশোর বয়স থেকেই ডিজের পরম ভক্ত ছিলেন। ২০১৯ সালে ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে তিনি নিজের উদ্যোগেই পূর্ব মেদিনীপুর থেকে প্রায় ৩০ হাজারটাকা দিয়ে ডিজে ভাড়া করে এনেছিলেন। বয়স্ক বাবা-মা বাড়িতে ছিলেন। রাত ১২টা নাগাদ যখন তাঁর বাবার শরীর খারাপ হয় তখন ডিজের উৎকট শব্দের জন্যই সেই রাতে ফোনে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর মাও ছেলেকে ফোনে পায়নি। পরিশেষে বৃদ্ধা মা অনুষ্ঠান স্থলে গিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে ডিজে বন্ধ করতে বলে বলে তাঁর স্বামীর অসুস্থতার ঘটনাটি শোনান। সঙ্কটজনক অবস্থাতে পলাশবাবু তাঁর বাবাকে ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি করে যে যাত্রায় বাবাকে ফিরে পেয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাতেই তিনি সারা জীবনের মতো ডিজে বাজানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আমরা চাই না, মানুষ পলাশবাবুর মতো বিপদের মুখোমুখি থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ডিজে বাজানো বন্ধ করে দিক। নিজে থেকে সচেতন হয়ে, সুস্থ সমাজের কথা ভেবে ডিজে বাজানো বন্ধ করুক। শুধু ডিজে নয়, যে সমস্ত আনন্দের বিষয়গুলি অন্যকে বিরক্ত করে, বিপদে ফেলে সেগুলি থেকে বিরত থাকুক।