তৃপ্তি পাল কর্মকার, ‘স্থানীয় সংবাদ’, ঘাটাল: তারিখটা ছিল ৩১ জুলাই ২০২১-এর রাত। দুদিনের টানা নিম্নচাপের বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট সব জল থই-থই। আর ভয় ধরাচ্ছে শিলাবতী। ফুঁসছে শিলাবতী। বছরভর ঘাটালের বুক চিরে বয়ে যাওয়া শীর্ণকায়া শিলাবতীর জল উঠেছে বিপদ সীমার চরম উপরে। সেচ দপ্তরের বয়ান অনুযায়ী ২০১৭ সালে যে বন্যা হয়েছিল তার চেয়েও আড়াইফুটের বেশি জল বইছে শিলাবতী দিয়ে। বাঁধে কাতারে কাতারে লোক ভিড় জমাচ্ছে। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে এবছরের মতো ভয়ঙ্কর জল আগে শিলাবতীর বাড়েনি। শিলাবতীর পূর্ব দিকে প্রতাপপুর, হরিসিংহপুর থেকে দাসপুরের সিমলার দহ পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় বাঁধে ঘোগ দেখা যাচ্ছে। সারা বাঁধে সেচদপ্তর,
প্রশাসনের নজরদারির সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বাঁধ লাগোয়া গ্রামবাসীরা। বাঁধে বস্তা দিচ্ছেন, রিং বাঁধ দিচ্ছেন, তবু যেন জল বেড়েই চলেছে। বস্তা ছাপিয়েও জল বইছে বাঁধের উপর দিয়ে। সবচাইতে ভয় ধরাচ্ছে প্রতাপপুর। বাঁধের অবস্থা ভালো নয়। দুর্বল বাঁধে জায়গায় জায়গায় ঘোগ। মহকুমা প্রশাসন, সেচ দপ্তরের নজর ওই প্রতাপপুরের ওপরে। প্রতাপপুরের পোড় খাওয়া প্রবীণরা এতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আগে দেখেননি। এলাকার বয়স্কদের অনেককেই আত্মীয় বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে নদী বাঁধের চিত্রটা অন্যরকম। জায়গায় জায়গায় চারটে পাঁচটা স্তরে মাটির বস্তা দিয়ে উঁচু করেও জল উপচে যাচ্ছে। বড় বড় ঘোগ তৈরি হচ্ছে। আর পুরো
গ্রামের বাসিন্দারা খাওয়া দাওয়া ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বাঁধে মাটি দেওয়ার কাজে। বাড়ির মেয়েরা, বাড়ির বাচ্চারা সবাই মরিয়া হয়ে বাঁধ রক্ষার জন্য লড়াই করছে। প্রশাসনের তরফে কখন আসবে মাটির বস্তা, সে অপেক্ষা করেননি প্রতাপপুরবাসী। নিজেরাই বস্তা জোগাড় করে বাস্তুর মাটি কেটে, জমির মাটি কেটে বস্তায় ভরে ভরে তৈরি করেছেন রিং বাঁধ। বাঁধে ফেলেছেন মাটি। প্রশাসনের তরফে বস্তা আসতে দেরি হচ্ছিল, তাই ক্ষোভ হলেও কাজ বন্ধ করেননি তাঁরা। আত্মীয়রাও শিলাবতীর জল বাড়তে দেখে থেমে থাকতে পারেননি। তাঁরাও বস্তা দেবার কাজে লেগে পড়েছিলেন। তবু বড় বড় ঘোগ, হানা দেখে রাতে বাসিন্দারা ধরেই নিয়েছিলেন আর রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। বন্যা হতে চলেছে। আরও মরিয়া প্রতাপপুর বাসী। রুখতেই হবে বন্যা।
আর যদি এই বাঁধ ভাঙত তাহলে প্লাবিত হত ঘাটাল পুরসভার পাঁচটি ওয়ার্ড, ঘাটাল ব্লকের দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত সহ দাসপুর-১ এবং দাসপুর-২ ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা। যে এলাকাটি রূপনারায়ণ, শীলাবতী ও কংসাবতী নদী দ্বারা বেষ্টিত এবং একাশি মৌজা হিসেবে সর্বজন বিদিত। ২০১৭ সালে প্রতাপপুর ভেঙেই একাশির মৌজা প্লাবিত হয়েছিল। বহুদিন ধরে দুর্ভোগে পড়েছিলেন এই এলাকার মানুষ। সেই ক্ষত মানুষ ভুলতে না ভুলতেই আবার ৩১ জুলাই এবং ১আগষ্ট ২০২১ আরও ফুঁসে ওঠা শিলাবতী দেখে দুশ্চিন্তার প্রহর গুনেছে একাশি মৌজার বাসিন্দারা। ক্রমশ বাঁধ খারাপের দিকে। তাই দাসপুর, ঘাটাল এলাকায় মাইকিং করে বন্যার সতর্কতা দেওয়া হচ্ছে মানুষকে। এদিকে প্রশাসনের নজরদারির সঙ্গে সঙ্গে জান লড়িয়ে সারারাত ধরে বাঁধে মাটি ফেলছেন পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ির মা-বউরা। পদে পদে চরম বিপদ। একবার হঠাৎ করে যদি ঘোগ বড় আকার ধারণ করে তাহলে জলের তোড়ে ভেসে চলে যেত কাজ করতে আসা অনেক মানুষ। প্রাণের ভয়ের তোয়াক্কা না করে সারাদিন-রাত মরিয়া হয়ে কাজ করেছেন গ্রামবাসীরা। তাই বুঝি অসম্ভব সম্ভব হল। ভাঙতে ভাঙতেও ভাঙল না প্রতাপপুর। একটু বসে গেলেও কোনও মতে রক্ষা পেল বাঁধ।
৮১ মৌজার মানুষ ধরেই নিয়েছিলেন ভয়ঙ্কর বন্যা এবার হচ্ছেই। দাসপুরের সিমলার বাঁধ থেকে প্রতাপপুর পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় ঘোগ দিয়ে জল বেরোচ্ছে, নদী বাঁধের উপরে তিন চারটে বস্তা দিয়েও জল উপচে বইতে শুরু করেছে। উদ্বেগের প্রহর যেন কাটতেই চাইছে না। সব থেকে বেশি খারাপ অবস্থা ছিল প্রতাপপুর বাঁধের। বহু জায়গায় ঘোগ তো ছিলই। বাঁধ বসে গিয়ে এইগেল ওইগেল অবস্থা।
গ্রামবাসীরা বাঁধে না পড়ে থাকলে কিছুতেই সেদিন বাঁধ রক্ষা সম্ভব হতো না। যতই প্রশাসন সজাগ থাক, সেচ দপ্তরের নজরদারি থাক এই মানুষগুলো প্রশাসনের সজাগ হবার আগে থেকেই বাঁধ রক্ষা করতে নেমে পড়েছিলেন। নাহলে এবার বাঁধ রক্ষার মত অসম্ভব সম্ভব ছিল না। প্রশাসন থেকে কে কতটা মজুরি পাবে কি না পাবে তার তোয়াক্কা বা আশা না করে প্রতাপপুর এলাকার এই বাঁধ রক্ষার নায়ক নায়িকারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। উৎকণ্ঠার রাত কাটিয়ে শয়ে শয়ে মানুষের পরিশ্রমে বাঁধ ভাঙেনি, এটাই তাদের পরিতৃপ্তি।
দাসপুর থানা এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা এবং ঘাটাল থানা এলাকার একাংশের বাসিন্দারা যারা এই ভয়ঙ্কর বন্যার হাত থেকে এবারের মতো রক্ষা পেলেন, তাঁরাও স্যালুট জানিয়েছেন বাঁধ রক্ষার প্রকৃত নায়ক-নায়িকাদের।
ঘাটালের মহকুমা প্রশাসন কিম্বা সেচ দপ্তর কেউই এলাকার বাসিন্দাদের ওই দু’দিনের দিনরাত এক করে লড়াইয়ের কথা অস্বীকার করেনি। ঘাটালের মহকুমা শাসক সুমন বিশ্বাস ওই দুই রাতেই বার বার সংবাদ মাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন সেচ দপ্তরের সঙ্গে গ্রামবাসীরা হাত না লাগালে প্রতাপপুরের বাঁধকে রক্ষা করা যেত না। তাই ওই এলাকার গ্রামবাসীদের মহকুমা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদও জানানো হয়েছে। এদিকে ঘাটাল মহকুমা সেচ ও জলপথ দপ্তরের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার সুমিত দাস বলেন, ওই সময় বাঁধ রক্ষার জন্য আমাদের একমাত্র ভরসা ছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। অতো রাতে আমরা বাঁধ মেরামতির জন্য বহিরাগত কোনও শ্রমিকই পেতাম না। তাই বাঁধ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা যদি আগু-পিছু চিন্তা না করে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাঁধ রক্ষার কাজে হাত না লাগাতেন আমাদের পক্ষে কখনই ওই বাঁধ রক্ষা করা সম্ভব হত না।