এই মুহূর্তে ক্রীড়া/অনুষ্ঠান অন্যান্য সাহিত্য সম্পাদকীয় নোটিশবোর্ড

অপসংস্কৃতির বাহকদের মুখে সংস্কৃতির জয়গান: সংস্কৃতি না রাজনৈতিক ব্যবসা

Published on: February 4, 2021 । 7:49 AM

সেদিন আমি ঘাটাল থেকে ফিরছি। এমন সময় একটা রাজনৈতিক দলের সভামঞ্চ থেকে মাইকে একজন নেতার বক্তব্য শুনতে পেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গেলাম।বক্তা একজন শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা নয় পরন্তু একজন জনপ্রতিনিধি ও বটে। তিনি বলছেন, বাংলায় নাকি আগে কোন সংস্কৃতি ছিল না।তারাই নাকি বাংলার বুকে সংস্কৃতি ফিরিয়ে এনেছেন। বাংলা নাকি তাদের রাজত্বের পূর্বে সংস্কৃতিকে হারিয়েছিল। লোকসংস্কৃতি অস্তাচলে চলে গিয়েছিল। রবীন্দ্র-নজরুলকে কোনও  মূল্য দেওয়া হয়নি। লোকশিল্পী, যাত্রাশিল্পীদের  কোনও  গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।তারাই নাকি বাংলার হৃতগৌরবকে ফিরিয়ে এনেছেন।
ভাবতে শুরু করলাম। ইনি কোন সংস্কৃতির কথা বলছেন! এটা ঠিক গাঁয়ে গাঁয়ে ছেলে মেয়েরা সংস্কৃতি মঞ্চ তৈরি করে গান বাজনা করে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মেলা হচ্ছে। সুভাষ মেলা, বিবেকানন্দকে নিয়ে বিবেকমেলা, রাখী বন্ধন উৎসব, মাটি মেলা, বইমেলা, শিল্পমেলা—আরো আরো কতকিছু।পাড়াতে পাড়াতে প্যাণ্ডেল বেঁধে বিভিন্ন পুজোকে সামনে রেখে গান বাজনা হৈচৈ তো আছে। সেই সঙ্গে দ্রিম দ্রিম মাইকের বিভৎস শব্দদূষণ। নেতারা  এগুলোকেও সংস্কৃতি বলেন। এগুলোকে সংস্কৃতি না বললে তাদের রাজনৈতিক মুনাফা আসবে কোথা থেকে?

বাংলার মানুষ সংস্কৃতি চায়। সংস্কৃতি হচ্ছে এক আলোকবর্তিকা, এক উজ্জ্বল মশাল যা মানুষের আত্মসম্মান ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করার পথ দেখায়। মানুষের উন্নত জীবন যাপন করার দিকনির্দেশনা করে।
যে সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে সেটা নিয়েই মনে প্রশ্ন এলো সংস্কৃতি মানে নিছকই উৎসব, গানবাজনা, কবিতা আবৃত্তি, যাত্রা উৎসব। তার বাইরে কি কিছুই নয়? উন্নত জীবন, ব্যক্তি সাতন্ত্র্যবোধ, সমাজবোধের উন্মেষ এগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বলে কিছুই নয়? সংস্কৃতি কি নিরপেক্ষ? বুদ্ধিজীবীরা কি বলেন! এদের একটা বড় অংশই বলেন ‘শিল্প হলো শিল্পীর মনের লীলাময় বহিঃপ্রকাশ যার কোনও অভিমুখ থাকে না। কেন বলে , কেন লেখে লেখক-শিল্পী সেটা জানে না।’ সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ঘটনা শিল্প-সাহিত্যের উপর প্রভাব ফেলবে না সেটা কখনোই হতে পারে না। যদি তাই হতো শিকল ভাঙার গান লিখে নজরুলকে জেলে যেতে হতো না, দীনবন্ধু মিত্রের জেল ও জরিমানা হতো না। পরাধীন ভারতবর্ষে মুকুন্দ দাসের স্বদেশী যাত্রাদলের জন্য জেল হতো না। পরাধীন ভারতবর্ষের এই ঘটনাগুলো বাদ দিলেও স্বাধীন ভারতে তরুণ অপেরার কালজয়ী উপস্থাপনা স্তালিন, লেনিন, কালমার্কস, কালপুরুষ, সুভাষচন্দ্র- নাটকগুলি অভিনয়ের জন্য বার বার আক্রান্ত হয়েছে।

এর থেকেই প্রমাণিত সত্য, যে পদ্ধতি মানুষের মননের স্বাধীনতা হরণ করে, মানুষের অধিকার-দূর্দশা -অধিকারবোধের বিরোধী তা করে তাকে অপসংস্কৃতি বলে। শুধু তাইই নয় মানুষের সৃষ্টিশীল চেতনাকে ও হরণ করে এই অপসংস্কৃতি।
ভাষাতাত্ত্বিক ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেছেন সংস্কৃতি তিনটি ধাপের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথমতঃ ফ্রিডম অফ মাইন্ড বা মননের স্বাধীনতা। মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। পৃথিবীর জল-বায়ূ-আকাশ-বাতাসে তার সমান অধিকার। তার দেশের সম্পদের উপর তার সমান অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের শিশুরা মাথায় ঋণের বোঝা নিয়েই তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। এছাড়া মানুষের শ্রমের দাম নির্ধারণ হচ্ছে শ্রমশক্তিকে যারা কেনে তাদের মর্জির উপরে। বিয়েতে থাকে পণপ্রথা। সেটাকে নিয়ে পাত্র ও পাত্রীপক্ষের দর কষাকষি, মহাজনের কাছে অপমানজনক শর্তে ঋণ নেওয়া, শিক্ষিত বেকার ছেলে মেয়েদেরকে কেবলমাত্র একটা চাকরির জন্য তার চেয়ে হাঁটুর নীচে যোগ্যতাসম্পন্ন চরিত্রহীন ,মদ্যপ নেতার শরণাপন্ন হওয়া– এগুলোকে কখনই মননের স্বাধীনতা বলা যেতে পারে না। যেটা বর্তমানে আমাদের দেশে হামেশাই হচ্ছে। চাকরির নামে টাকাপয়সার লেনদেন চলছে। সুকুমারমতি যুবকদের হাতে লাঠি- আগ্নেয়াস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে তাকে চাকরি দেওয়ার লোভনীয় শর্তে সুস্থ পরিবেশকে বিষাক্ত করছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য তাদেরকে বলি দিচ্ছে। মননের স্বাধীনতা আজ এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশে সম্পূর্ণ বিপন্ন। সংস্কৃতির প্রথম শর্ত সম্পূর্ণই আজ উপেক্ষিত। যেটুকু মানুষের অধিকার বোধ আছে সেটা হলো ঠিক থানায় একজন যুবককে পুলিশ তার টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে যদি বলে তোমাকে তোমার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হলো টেবিলের তিনটি রুলকাঠ বেছে নেওয়ার, যেটা দিয়ে তোমাকে মারা হবে। মার তোমাকে খেতেই হবে।তবে কোন রুলকাঠে মারবো  সেটা সিলেকশন করার অধিকার তোমার। বুঝুন! আপনি বুঝুন আপনার সংস্কৃতি কোন জায়গায়। তার লাগামটা কার হাতে।এটা আর নাচা-গানা-খানা এক হলো? আসলে মননের স্বাধীনতা  পেতে গেলে অনেক বাধা , অনেক প্রতিবন্ধকতাকে পার হতে হবে। যে পথটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। যিনি মাইকে বাংলার সংস্কৃতি সংস্কৃতি বলে গলা ফাটাচ্ছেন, সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইটা হয়তো প্রথমেই তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে করতে হবে।
দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো ইউনিভার্সিলিসম বা বিশ্বজনীনতা। বিশ্বজনীনতা আর  হিউম্যানিটি একে অপরের পরিপূরক।এই দু’টো শব্দের মর্মকথা হলো মানবিকতা। মানবিকতা না থাকলে কেউ অপরের ব্যথা, লাঞ্ছনা, বেদনা উপলব্ধি করতে পারে না। সেকারণেই  যারা ভাবেন জলে নামবো ,গা ভেজাবো ,বেণী ভেজাবো না তাদের জন্য এ জিনিস নয়। যারা ইউনিভার্সিলিসম আনার লড়াই করে গেছেন তাদের মধ্যে একজন দাসবিদ্রোহের স্পার্টাকাস, যার মালিকের বিরুদ্ধে আনুগত্য বজায় রেখে চলার কথা। কিন্তু তিনি তা না করে সেই ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। চৈতন্য মহাপ্রভু যিনি নিজে একজন ব্রাহ্মণসন্তান হয়ে সরাসরি সমসাময়িক যুগের সেই ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।ফলে তাঁকে হিন্দু রক্ষণশীলদের রোষে পড়তে হয়েছে। এমনকি তাকে তার প্রাণটাকে পর্যন্ত রক্ষণশীলদের নির্মমতায় হারাতে হয়েছে। একইভাবে আমাদের দেশে বরেণ্য সন্তান ক্ষুদিরাম বসু, মাষ্টারদা সূর্যসেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ তাঁরাও সমসাময়িক বিট্রিশ শাসকদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে হাসিমুখে প্রাণবিসর্জন দিয়েছেন। এই জাতের লোকেরা অচলায়তের বুকের উপর বসেই অচলায়তনকে ভাঙেন, গড়েন, পরিবর্তন করেন। প্রয়োজনে আত্মাহুতি দেন।সমকালে ইনিরা নিন্দিত হোন, উপেক্ষিত হোন কিন্তু পরবর্তীকালে ইনিরা জাতি- বর্ণ- ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের কাছে পূজিত হোন। আসলে স্রোতের অনুকূলে নৌকা বাওয়ার লোক এঁরা নন।এনারা হলেন সেই লোক যারা স্রোতের প্রতিকূলে নৌকাকে নিয়ে যান। এইজন্যই এদের সংখ্যাটা অত্যন্ত কম। ইনিরা সংস্কৃতি বা পরিবর্তন বলে যা বুঝেন, যা করেন।মাইকে বক্তব্য রাখা বাংলার স্বঘোষিত সংস্কৃতির ঠিকাদারেরা নাচা- গানা- খানাকেই সংস্কৃতি বলবেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নাই।এনারা বিনা মূলধনে রাজনৈতিক ব্যবসা চালাচ্ছেন। প্রকৃত সংস্কৃতিকে গুলিয়ে দিয়ে আত্মকেন্দ্রিকতা-স্বজনপোষন ও বিবেকহীনতার চাষ করছেন। তাই সর্বাগ্রে এদের মুখোশগুলোকে উন্মোচন করা একান্ত জরুরি। তাতে আসতে পারে বাধা, আসতে পারে আক্রমণ, আসতে পারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।তাকে অতিক্রম করেই সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাই পথে এগিয়ে যেতে হবে।
সংস্কৃতির তৃতীয় স্তম্ভ হলো অ্যাবারনিটি বা শালীনতা।শালীনতা হলো একটা সীমারেখা যা পর্যন্ত করা যায়। তার বাইরে যাওয়া যায় না বা করা যায় না।এটাকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নিরিখে বাড়ানো বা কমানো যায় না। যেমন মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, ধর্মীয় ও সম্প্রদায় ভিত্তিক বিভাজনের ভিত্তিতে না দেখে সমদৃষ্টিতে দেখা এগুলো পড়ে। আপনি রাজনীতি করতেই পারেন। কিন্তু আপনার নেতা যদি আপনাকে বলে রাজনীতির নামে মানুষ খুন করতে হবে।আপনাকে যদি বলা হয় বিরোধী দলের লোকেদের বাড়িঘর লুঠ করতে যেতে হবে এবং আপনি যদি এগুলো করেন তখনই আপনি শালীনতার সীমা অতিক্রম করলেন। তখন আর আপনি সংস্কৃতির পূজারী থাকলেন না।আজকে দলের নামে কোন কোন সর্বভারতীয় দলের নেতা ঘোষণা করছেন মুসলমানদের মেয়েদেরকে কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করা দরকার। জাতপাত নিয়ে ধর্ষণ-খুনোখুনি হচ্ছে। এই সংক্রামক ব্যাধি বাংলা তথা ভারতবর্ষে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। অভিনয়জগতেও আপনি লক্ষ্য করুন। সেখানে দেখতে পাবেন অভিনয়ের কূশলতা দিয়ে নয় বরং কে কে কতখানি কাপড় খোলে, চটকদারি অমার্জিত ডায়লগ বলতে পারে তার এক লাগামহীন প্রচেষ্টা চলছে।
অস্হির আমাদের দেশ। অস্হির আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্হা।সারা বিশ্বের আধিপত্যকামী শক্তি আমাদের দেশে পাকাপাকি ভাবে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে অপসংস্কৃতির চাষ শুরু করেছে। অপসংস্কৃতি হলো আগাছা।আগাছা চাষ করতে হয় না। এমনিতেই হয়। তার উপরে উভয় শাসকদলের মধ্যে থেকে এই ধরণের ধৃষ্ট আস্ফালন বাড়ছে। কনজিউমার কালচারের মাধ্যমে এমনভাবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে যে তুমি তোমার ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য চুরি ডাকাতি ছিনতাই করতে পারো। রাজনীতি করতে গেলে খুন-খারাপি, মিথ্যা কথা বলা কোনও অপরাধ নয়।চুরি ডাকাতি উৎকোচ গ্রহণ করা লোকগুলোকে মহামানব বানিয়ে তাদের মাথায় করে নাচানাচি চলছে।
যদি সত্যিই বাংলার সাংস্কৃতিক উন্নয়ন হয়ে থাকে তাহলে এত ধর্ষণ কেন? কেনই বা সরকার ধর্ষিতার রেট বেঁধে দিয়েছে? কেনই বা এত খুনোখুনি? কেনই বা মহিলাদের উপর অ্যাসিড নিক্ষেপ? এগুলো কি সংস্কৃতির মাপকাঠি? রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে গাড়ি ও পথচারীদের ঘিরে চাঁদা আদায়ের নামে জুলুম চলছে। প্যাণ্ডেল সংস্কৃতির নামে উৎকট বাজনা সারারাত বাজছে।প্রশাসন নীরব। এরপরও কি অপসংস্কৃতির বাহকদের কাছে শুনতে হবে আমরা বাংলার বুকে সংস্কৃতির স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছি!

রবীন্দ্র কর্মকার

ঘাটাল মহকুমার যে কোনও ঘটনা ও তথ্য জানা থাকলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার করুন। মো: 9933998177

Join WhatsApp

Join Now

Join Telegram

Join Now