দেবাশিস কর্মকার:এবার আন্তর্জাতিক মঞ্চেও উঠে এল ঘাটালের নাম! আলোর মেরুকরণের মৌলিক ব্যবহারিক গবেষণার উপর আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছেন ক্ষীরপাই শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ড মালপাড়ার বাসিন্দা নির্মাল্য ঘোষ। আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর অপটিকস অ্যান্ড ফটোনিকস ২০০৪ সাল থেকে আলোক মেরুকরণের মৌলিক ব্যবহারিক গবেষণার উপর গবেষণার জন্য প্রত্যেক বছর সারা বিশ্বে এক জনকে ‘জিজি স্টোক অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে থাকে। ক্ষীরপাই শহরের বাসিন্দা ওই গবেষককে ২০২১ সালের ‘জিজি স্টোক অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার দেওয়ার কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ওয়াশিংটনে এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁর হাতে ওই পুরষ্কার তুলে দেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে। পদার্থ বিদ্যায় লাইট পোলারাইজেসন তথা আলোর মেরুকরণ বিষয়ের উপর মৌলিক গবেষণা ও পদার্থবিদ্যা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার ব্যবহারিক দিকের বিষয়টিতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি আনার জন্য তাঁকে ওই সম্মান দেওয়া হচ্ছে। শুধু বাঙালি হিসেবেই নয়, ভারতীয়দের মধ্যে এই প্রথম কোনও বিজ্ঞানী এই বিরল সন্মান লাভ করলেন। [•এই খবর সংক্রান্ত 👆🏽ভিডিও]
বর্তমানে নির্মাল্যবাবু কলকাতা আইজারের (ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ) অধ্যাপক। নির্মাল্যবাবু বলেন, আমার দীর্ঘ দিনের গবেষণা সফল হয়েছে তার জন্য ভালো তো লাগছেই। ভারতবাসী হিসেবে প্রথম এই পুরস্কারটি পাওয়ার জন্য আমি আপ্লুত। নির্মাল্যবাবুর এই সাফল্যে গর্বিত ঘাটালবাসীও।
নির্মাল্যবাবুর শৈশব কেটেছে ঘাটালেই। ঘাটাল মহকুমার ক্ষীরপাইয়ে তাঁর স্কুলশিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে বিএসসি এবং এমএসসি করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে আইআইটি কানপুর থেকে লেজার টেকনোলজিতে এমটেক, ইন্দোর থেকে পিএইচডি করেন। পাশাপাশি দীর্ঘ নয় বছর সায়েন্টিস্ট হিসাবে সেখানে কর্মরত ছিলেন। অন্যদিকে পরে কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট-ডক্টরেট লাভ করেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে এসে কলকাতার আইজার থেকে আলোক বিষয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি ‘বায়োন্যাপ’ নামের একটি আলোকের জৈবিক এবং ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ক গবেষণাগার গড়ে তুলেছেন যেখানে বহু গবেষকরা সংশ্লিট বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণা চালাচ্ছেন। নির্মাল্যবাবু গত ১০ বছর ধরে ওই গবেষণা সংস্থায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
কী এই লাইট পোলারাইজেশন? এর উত্তরে নির্মাল্যবাবু জানিয়েছেন, তাঁর গবেষণায় আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মেরুকৃত আলো পদার্থের উপর ফেলে বিচ্ছুরিত বর্ণালী পর্যবেক্ষণের দ্বারা পদার্থের কম্পোজিশন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। বর্তমানের টেকনোলজি ব্যবহার করে অনেক সময় কোষ বা কোষের ভেতরকার বিষয়গুলো নিখুঁত করে দেখা যায় না। কিন্তু এই আলোর মেরুকরণ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে পদার্থের গঠনগত সেই অজ্ঞাত সূক্ষাতিসুক্ষ বিষয়গুলি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব বলে তিনি মত পোষণ করেছেন। তাঁর দাবি, এর ফলে ক্যানসারের মত জটিল রোগেরও চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন কোনও কিনারা করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ তার গবেষণার বিষয় মূলত পদার্থবিদ্যা হলেও এর সুফল চিকিৎসাবিজ্ঞানেও সমান ভাবে মিলবে। এছাড়াও তাঁর গবেষণার অন্য একটি দিক হল ন্যানো টেকনোলজি তথা ন্যানো প্রযুক্তি। আলোক বিষয়ক তাঁর দীর্ঘ গবেষণা ন্যানো প্রযুক্তির অগ্রগতিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে তাঁর দাবি।
নির্মাল্যবাবু বলেন, আলোক নির্ভর ন্যানো টেকনোলজিতেও এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে অনেক উন্নতমানের ব্যবহারিক বৈদ্যুতিন যন্ত্র তৈরি করা যেতে পারে। তবে বর্তমানে পুরো বিষয়গুলিই গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। সরাসরি প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও কিছুটা সময় লাগবে।
কর্মসূত্রে নির্মাল্যবাবু বর্তমানে কল্যাণীতেই থাকেন। তবে সুযোগ পেলেই চলে আসেন দেশের বাড়ি। শৈশব এবং স্কুলজীবন ক্ষীরপাই শহরে কাটার জন্য ঘাটাল সব দিনই তাঁর কাছে স্মৃতি বিজড়িত আবেগের বিষয়। তাই সময় সুযোগ হলেই কিছু সময় কাটিয়ে যান দেশের বাড়িতে। তাছাড়া ঘাটালে তার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও কম নয়। নির্মাল্যবাবুর মা রুচিরাদেবী বহুদিন আগেই পরলোকগমন করেছেন। তবে তাঁর বাবা শক্তিসাধন ঘোষ ক্ষীরপাইয়ের বাড়িতেই থাকেন। শক্তিসাধনবাবু ক্ষীরপাই উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি বলেন, আমি চাই আমার ছেলে আরও এগিয়ে যাক।
নির্মাল্যবাবুর এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারের কথা জানতে পেরে উৎফুল্লতা চেপে রাখতে পারেননি স্ত্রী শাশ্বতী ঘোষ এবং পুত্র সোহম ঘোষও। আবেগ আপ্লুত হয়েছেন বিজ্ঞানীর পরিবার-পরিজন সহ ঘাটালের বাসিন্দারা। নির্মাল্যবাবুর এক কাকা মুক্তিপদ ঘোষ দাসপুর-২ ব্লকের গৌরা-সোনামুই হাইস্কুলের শিক্ষক। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে কুচাইয়ের(নির্মাল্যবাবুর ডাকনাম) পড়াশোনাই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। আমরা চাই ওর পড়াশোনা, ওর আবিষ্কার সারা বিশ্বের মানুষের কাজে লাগুক। নির্মাল্যবাবুর এক বোন অনুমিতা ঘোষ বলেন, দাদার এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্তি আমাদেরকে অনেকটাই প্রেরণা জুগিয়েছে। আমরা ঘাটাল মহকুমা তথা রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা দাদাকে আইকন করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পাব। অন্য দুই বোন তৃপ্তি ঘোষ এবং শুভমিতা ঘোষ একই অনুভূতি ব্যক্ত করেন। প্রথম ভারতীয় হিসেবে নির্মাল্যবাবু এই পুরস্কার পাওয়ায় গর্বিত দাদা সন্দীপ ঘোষ, বৌদি বর্ণালী ঘোষ, সেজো কাকা ভক্তিরঞ্জন ঘোষ এবং সেজো কাকিমা শুক্লা ঘোষ।
ঘাটাল মহকুমার ওই গবেষকের সাফল্যে খুশির জোয়ারে ভাসল ক্ষীরপাইবাসীও। ২৪ জানুয়ারি ক্ষীরপাই পৌরসভার পক্ষ থেকে নির্মাল্য ঘোষকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ক্ষীরপাই পুরসভার প্রশাসনিক বোর্ডের চেয়ারপার্সন দুর্গাশঙ্কর পান বলেন, আমি নির্মাল্যবাবুকে তার ছোট বেলা থেকেই চিনি। এক দিকে নির্মাল্যবাবু যেমন পড়াশোনায় ভালো ছিলেন তার পাশাপাশি উনি নিজে একজন ভালো ক্রিকেটার ছিলেন। তাই খেলার মাঠেই তাকে ওই দিন ক্ষীরপাইবাসীর পক্ষ থেকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হল। তিনি বলেন, আমাদের গর্বের গবেষককে সামনে থেকে সংবর্ধনা দিতে পেরে আমাদেরও খুব ভালো লাগছে।
ক্ষীরপাই শহরের বাসিন্দারা বলেন, এত বড় মাপের গবেষক হয়েও নির্মাল্যবাবুর মনে কোনও রকম অহঙ্কার নেই। মাঝে মাঝে যখন ক্ষীরপাই আসেন তখন সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গেই সুন্দর ব্যবহার করেন। যে সমস্ত সহপাঠীরা বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি এই শহরে এসে তাঁদের সঙ্গেই স্কুল জীবনের মতো একাত্ম হয়ে সময় কাটান। তাই তাঁর এই আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্তিটা যেন শহরবাসীরই সম্মান প্রাপ্তি হয়েছে। গবেষকের বাবার জন্মস্থান চন্দ্রকোণা থানার বাগপোতা গ্রামে। নির্মাল্যবাবুর আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তির খবর ওই গ্রামে পৌঁছাতেই বাগপোতা গ্রামেও বইতে থাকে খুশির হাওয়া।