দেবাশিস কর্মকার:সন্তানের দীর্ঘ মাতৃভক্তির পেছনে তবে নিছকই বিষয়-সম্পত্তি লাভের অছিলা! যে ছেলের মাতৃভক্তি একসময় সমাজের চোখে উদাহরণ হয়ে উঠেছিল তা মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল মায়ের থেকে বিষয়-সম্পত্তির দানপত্র হাতে পাওয়ার পরই। সেই মা অন্ত-প্রাণ ছেলেটার ভাবমূর্তি এক লহমায় এভাবে বদলে যাবে নিজেও কল্পনা করতে পারেননি দাসপুরের অশীতিপর বৃদ্ধা করুণা কালসার। ২০১৪ সালে ছেলেকে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার পর বর্তমানে আর নিজের বাড়িতেই থাকার জায়গা পাচ্ছেন না। দু-বেলা দুমুঠো পেট ভরে খাবারও জুটছে না তাঁর। বিধবা মায়ের প্রতি এতটাই নিষ্ঠুর এবং অমানবিক হয়ে গিয়েছেন সেই মা ভক্ত ছেলে। ছেলের এই ধারাবাহিক নির্দয় আচরণে কার্যত দিশেহারা হয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন করুণাদেবী। অভিযোগ, পাওয়ার পরই দানপত্রের দলিল খারিজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ঘাটাল মহকুমার ট্রাইব্যুনাল ফর মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্সের প্রিজাইটিং অফিসার তথা ঘাটালের মহকুমা শাসক অসীম পাল। শুধু তাই নয় পাশাপাশি বৃদ্ধা মাকে তাঁর ভরণপোষণের জন্য প্রতি মাসে ৩০০০ টাকা করে দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই ‘গুণধর’ ছেলেকে।
বর্তমানে করুণাদেবীর বয়স আশি বছরের আসে পাশে। তাঁর বাড়ি দাসপুর-১ ব্লকের সুজানগরে। প্রায় ৪০ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। করুণাদেবী তাঁর বাবার কাছ থেকে পুকুর, বাস্তু, জমি মিলিয়ে প্রায় ৮১ শতক জায়গা পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালে সেই জমির মূল্য ছিল ১৬ লক্ষ টাকার বেশি। তাঁর দুই ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে এবং মেয়েকে হারিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। তাঁর ছোট ছেলে বীরেশ পেশায় বাঁশ ব্যবসায়ী। বৃদ্ধা ওই ছোট ছেলের কাছেই থাকতেন। ওই বৃদ্ধা অভিযোগ করেছেন, তাঁর ওই ছোট ছেলে বছর ছয়েক আগে তাঁকে ডাক্তার দেখানোর নাম করে দাসপুর গঞ্জে নিয়ে যান। সেখানেই কৌশলে তাঁর কাছ থেকে ১৬ লক্ষ টাকার সম্পত্তি লিখিয়ে নেন।
ছেলের এই কাজে মনে মনে আহত হয়েছিলেন তিনি। যদিও পরে সম্পূর্ণ বিষয়টি মন থেকে মুছে দেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলের দুর্ব্যবহার বাড়তে থাকলে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি তিনি। তাঁর অভিযোগ, ছেলে তাঁকে ঠিক মত খেতে দিত না। শরীর খারাপ হলে ছেলে বিষয়টিকে উড়িয়ে দিত। এছাড়াও নানা রকমের নির্যাতন করত বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।
কয়েক বছর হল করুণাদেবীর কোনও স্থায়ী বাসস্থান নেই। এখানে-ওখানে ঘুরেই দিন কাটাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি তার এক নাতনি তথা মৃত বড়ছেলের মেয়ের বাড়িতে আছেন। সেখান থেকেই ওই ট্রাইবুনালে বিচারের জন্য আবেদন করেন তিনি। সম্প্রতি ট্রাইব্যুনাল থেকে ওই দানপত্র বাতিল করার জন্য দাসপুর-১ ব্লকের সাব রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রত্যেক ইংরেজি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বৃদ্ধা মাকে টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধার সম্পত্তির উপর যে সমস্ত স্থায়ী ও অস্থায়ী নির্মাণ করা হয়েছে, তাও সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৃদ্ধার ছেলে অবশ্য অন্য কথা জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, তাঁর মা নিজে থেকেই তাঁর কাছে থাকতে চাইছেন না। তিনি মায়ের সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেননি। লিখে দেওয়া সম্পত্তি তাঁর ভাইপোকে দেবেন স্থির করতেই মায়ের সঙ্গে ঈষৎ মতবিরোধ হয়। সেই থেকে মা তাঁর কাছে থাকেননি।
প্রসঙ্গত, সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় আইনে বলা হয়েছে, যখন কোনও সিনিয়র সিটিজেন দানপত্র বা অন্য কোনও মাধ্যমে সম্পত্তি বা অন্য কোনও সম্পদ তাঁর সন্তানসন্ততি বা কোনও ব্যক্তিকে দেবেন সেক্ষেত্রে ওই সম্পত্তি প্রাপকেরও কয়েকটি নির্দিষ্ট দায়বদ্ধতা থাকবে। তিনি সম্পত্তি ওই প্রদানকারী সিনিয়র সিটিজেনকে তাঁর মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করতে বাধ্য থাকবেন। তাঁর শারীরিক এবং মানসিক সংহতি বিধান করবেন। অন্যথায় আইনিভাবে ধরে নিতে হবে তিনি ওই সম্পত্তি প্রতারণা এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হস্তগত করেছেন। এই বিষয়ে ওই সংশ্লিষ্ট আইন অনুসারে স্থানীয় ট্রাইবুনাল তার সম্পূর্ণ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। তাই ট্রাইব্যুনাল ফর মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্স আইন (২০০৭) অনুযায়ীই বীরেশবাবুকে দানপত্র করে দেওয়া দলিলটিকে বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইবুনালের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন সারা মহকুমার মানুষ। তাঁরা ঘাটাল মহকুমার ট্রাইব্যুনাল ফর মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্সের প্রিজাইটিং অফিসার তথা ঘাটালের মহকুমা শাসককে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অভিনন্দনও জানিয়েছেন।
ঘাটাল মহকুমার সমস্ত খবর পেতে আমাদের MyGhatal মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করুন [লিঙ্ক 👆] এবং ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন[লিঙ্ক 👆]।