তৃপ্তি পাল কর্মকার : শতায়ু ছুঁইছুঁই। সামনের বৈশাখের আট তারিখ এলেই পা দেবেন শতবর্ষে। তিনি দাসপুরের খাটবাড়ুই গ্রামের কালীপদ প্রামাণিক। পড়াশোনা করতেন দাসপুরের বাসুদেবপুর হাইস্কুলে। সেখানে তৎকালীন সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান। তাই তারপর আর পড়াশোনা এগোয়নি। স্কুলের খাতার হিসেবেই কালীপদবাবুর বয়স বলছে তিনি একশো ছুঁইছুঁই।
ছেলেবেলায় খেলার ঝোঁকটা একটু বেশিই ছিল। ফুটবল খেলতে খুব ভালোবাসতেন। বয়সের টানে স্মৃতি খেই হারায়নি তাঁর। স্মৃতিতে আজো জ্বলজ্বল করে স্কুল থেকে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন নন্দনপুর। সেখানে একাই কিশোর কালীপদ চারটি গোল দিয়েছিলেন। সবার হাততালিতে ভরে উঠেছিল মাঠ। তারপর সেখানে সুন্দর গোলের জন্য তাকে মেডেল দেওয়া হয়। খেলার সেই টান রয়ে গিয়েছে আজও। এই বয়সেও সামনাসামনি খেলা হলে দেখতে যাবার লোভ ছাড়তে পারেন না। বিশেষ করে এই খেলা যদি আবার ফুটবল হয়, তবে তো কথাই নেই! স্ত্রী মেনকা প্রামাণিক মারা গিয়েছেন ৩০ বছর হল। মেনকাদেবী-কালীপদবাবুর সাত সন্তান। চার মেয়ে, তিন ছেলে। এক মেয়ে ও এক ছেলে ইতি মধ্যেই মারা গিয়েছেন। বর্তমানে এক মেয়ে সাবিত্রী হাজরা বাবার দেখাশোনা করেন। বাকি ছেলেমেয়েরা কেউ সেভাবে বাবার দায়িত্ব নিতে চাননি।
কৃষক কালীপদবাবুর টুকটাক সামান্য জমিজমা রয়েছে। তাতে করে বাবা-মেয়ের কোনমতেই চলে না। আজ পর্যন্ত মেলেনি কোনও সরকারি সাহায্য। বার্ধক্য ভাতা পর্যন্ত মেলেনি। সে নিয়ে সরকারের প্রতি ক্ষোভ, অভিমান দুটোই রয়েছে বাবা-মেয়ের। সাবিত্রীদেবী বলেন, সরকার মানুষকে কত কিছু দিচ্ছে। আমরা কেন পাচ্ছি না, জানি না। অথচ কী করুণ পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে হচ্ছে আমাদের। বর্তমানে বাবার বয়সের উপযোগী কোনও খাবার দিতে পারি না। সামান্য ডাল ভাতের সংস্থান করতেই বড্ড কষ্ট পেতে হয়। সেখানে একটুখানি ভালোমন্দ ধরাছোঁয়ার বাইরে, অলীক গল্পের মতো।
পরিস্থিতি যাই হোক কালীপদবাবু আজও ভোর চারটায় উঠে পড়েন। খানিক হাঁটাহাঁটির পর চা মুড়ি খেয়ে ঠাকুরের নাম গানে বসে পড়েন। তারপর দুপুর ১২ টায় আহার সেরে বিশ্রাম। তারপর পেপার পড়া। এটার জন্য আজ অবধি কোন চশমা লাগেনি। এখনও প্রখর রয়েছে চোখের জ্যোতি। প্রতি বুধবার, রবিবারে টালিভাটার হাট থেকে পায়ে হেঁটে বাজার করতে অভ্যস্ত কালীপদবাবু। চলাফেরা করতেও লাঠির সাহায্য লাগে না। তবে দাঁত অনেকগুলোই পড়ে গেছে। কানেও ঠিকঠাক শোনেন না। কিন্তু সবকিছু মনে আছে। অর্থাৎ স্মৃতি ঠিকঠাক। স্মৃতির খাতা উল্টেই বললেন স্বাধীনতার আগের কিছু কথা। রাধাকান্তপুরের অশ্বিনী দত্ত, সোনাখালির বিনোদ বেরা, বড়শিমুলিয়ার শম্ভু প্রামাণিক ছিলেন তখনকার স্বাধীনতা সংগ্রামী। এদের গোপন মিটিং হত টালিভাটার মতিলাল বেরার সিনেমা হলে, বলিহারপুরের সুশীল রায়, চারু রায়ের বাড়িতে। সেই সব গোপন মিটিঙে কিশোর বয়সে অংশ নিয়েছেন, তবে বাবার আদেশ ছিল সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে পড়তে হবে। কখনও কখনও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বাড়িতে থাকতেও দিয়েছেন। কিশোর বয়সের সে সব স্মৃতি এখনও টাটকা। একটুও খেই হারায়নি।
এলাকার মানুষ শতায়ু এই মানুষটিকে যথেষ্ট সমীহ করেন। খাটবাড়ুইয়ের বাসিন্দা তথা ব্যবসায়ী সৈয়দ সাব্বির আহমেদ বলেন, এবছর বেলতলা শিবদুর্গা কমিটি থেকে স্বাধীনতা দিবসের সময় প্রবীণ মানুষ হিসেবে ওনাকে নতুন পোশাক পরিয়ে, ওনার হাত দিয়েই পতাকা তোলানো হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি সাহায্যের খুব প্রয়োজন এই বৃদ্ধের। সরকারি সাহায্য পেলে এই বৃদ্ধ মানুষটি এই বয়সে কিছুটা ভালো থাকতে পারতেন। শতায়ু হওয়া মানুষ খুঁজলে হয়তো কিছু হলেও পাওয়া যাবে। কিন্তু এতোখানি সুস্থ মানুষ, বিশেষ করে এই বয়সে হয়তো পাওয়া যাবে না।
এই বয়সে সুস্থতার কারণ কী? কালীপদবাবু বলেন, ছেলেবেলায় তাদের এক পোষা গরু ছিল। গরুটি এত দুধ দিত যে জলের বদলে দুধ খেয়েই থাকতেন। ছেলেবেলায় খাওয়া অতো দুধ সুস্থতার কারণ বলে মনে করেন তিনি। এক দিদি রাণী সামন্ত, সম্প্রতি ১০৫ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন। অর্থাৎ দিদিও দীর্ঘায়ু ছিলেন।
বর্তমানে হাঁটাচলা, পেপার পড়া এই নিয়েই সময় কাটে কালীপদবাবুর। আর কাটে ঠাকুরের নাম গান করে। এক কালে নাম সংকীর্তন করতে যেতেন। এখন পারেন না। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় যাবার খুব ইচ্ছে হয়। তবে মাতালদের দৌরাত্ম্য খুব একটা পছন্দ নয়। সেজন্য ইচ্ছে হলেও আর যান না। অসহায় এই বৃদ্ধ আর তার কন্যা এখন অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন, কবে সরকার তাদের ওপর দৃষ্টিপাত করবে। •ছবিটি কালীপদ প্রামাণিকের।