দেবাশিস কর্মকার:সম্প্রতি ক্ষীরপাই পৌরসভা এলাকায় হঠাৎ করে আকাশ থেকে প্রায় ৩০-৪০ কেজি ওজনের একটি বরফের চাঁই পড়াকে কেন্দ্র করে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শুরু হয় নানা জল্পনা। কিন্তু ওই বিশালাকৃতির বরফের উৎস কী, কীভাবেই বা তা এল সে বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা এখনও গভীর অন্ধকারেই। অধিকাংশের ধারণা, শিলা বৃষ্টি যে কারণে হয় তেমনই কোনও হেতুতে ওই বরফের সৃষ্টি। আবার অনেকে মনে করছেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ফণী ঝড়ের মধ্যে এই বরফের সৃষ্টি-রহস্যের কোনও কারণ লুকিয়ে আছে। কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান এবং যুক্তি বলছে সম্পূর্ণ অন্য কথা। ওই বরফ সৃষ্টির পেছনে যে কারণগুলি সাধারণ মানুষ ভাবছেন তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। বরং এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে অন্য রহস্য। আসুন সে বিষয়ে একটু বিশদ আলোচনা করা যাক।
সবার প্রথম জানা প্রয়োজন, ওই বরফ সৃষ্টির পেছনে কোনও বিশেষ প্রাকৃতিক কারণের সরাসরি যোগাযোগ নেই। যাত্রীবাহী বিমানের টয়লেটে সঞ্চিত তরল বর্জ্যপদার্থ থেকেই ওই বরফের উৎপত্তি। সাধারণত যাত্রীবাহী বিমানগুলির টয়লেটে একধরনের রাসায়নিক রঞ্জক পদার্থ ব্যাবহার করা হয়। যা দুর্গন্ধ দূর করে এবং টয়লেটের মূল-মূত্রকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিয়োজিত করে এক তরল পদার্থে পরিণত করে। যাত্রীবাহী বিমানগুলিতে উড়ন্ত অবস্থায় এই বর্জ্যপদার্থ নির্গত করার কোনও পদ্ধতি নেই। যে কারণে তা মাটিতে নেমে আসার পরই টয়লেটগুলি পরিষ্কার করা হয়।
কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী উড়ানগুলি তুলনামূলক অনেক বেশি উচ্চতা দিয়ে যাতায়াত করে। ওই অতিরিক্ত উচ্চতায় আবহাওয়ার উষ্ণতা প্রায়শই শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে থাকে। ফলে বিমানগুলির টয়লেটে থাকা রঞ্জিত তরল বর্জ্যপদার্থ দ্রুত বরফে পরিণত হয়। এবং পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ জলের তুলনায়, ওই একই পরিমাণ জল থেকে সৃষ্ট বরফের আয়তন অনেক বেশি হয়। তাই অনেকসময় ওই বর্জ্যপদার্থের আধার অতিরিক্ত চাপে ফেটে যায় এবং তার মধ্যে থাকা বরফ বাইরে বেরিয়ে এসেই এই বিপত্তি ঘটায়। ইংরেজি পরিভাষায় এই বরফকেই বলা হয় ব্লু আইস (Blue Ice)। আর একটি প্রশ্ন থেকে যায়। সেটি হল ব্লু আইস শব্দবন্ধটিকে ঘিরে। এখানে ব্লু শব্দটির ব্যবহারের কারণ হল, যাত্রীবাহী বিমানের টয়লেটে ব্যবহৃত রাসায়নিক রঞ্জক পদার্থটির রং নীল হয়। যেটির উপস্থিতির জন্য উদ্ভূত বরফটি আংশিক নীল রঙের হয়ে থাকে। তাই এখানে ব্লু আইস অর্থে নীল বরফ কেই বোঝানো হয়েছে।
বিমান থেকে এই বিশাল বরফের চাঁই পড়বার ঘটনা নতুন নয়। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জায়াগায় এমন বরফ পড়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। ব্রিটেনের একটি সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২৫টি জায়গায় এমন বরফ পড়ার নজির মেলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৭ সালে ব্রিটেনের লেস্টার অঞ্চলে একটি বাড়ির কার্নিশে ওই বরফ পড়ে কার্নিশ ভেঙে যায়। এছাড়াও, ২০০৬ সালের ২০ অক্টোবরে একই ঘটনা ঘটে ক্যালিফোর্নিয়ার চিনো এলাকায়। শুধু বিদেশে নয়। ভারতেও এই ঘটনা বিরল নয়। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে মধ্যপ্রদেশের এক মহিলার কাঁধে একটি প্রায় ফুটবলের আকারের বরফ পড়ে গিয়ে তিনি গুরুতর জখম হন।
ঘটনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করে, ভারতীয় কোর্ট ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি নির্দেশিকা জারি করে। যেখানে বলা হয়েছে, বিমান থেকে কোনও রকম মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্যপদার্থ নির্গমন করা যাবে না। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ক্ষীরপাইয়ের ঘটনাটি প্রমাণ করল ওই নির্দেশিকা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি।