অতনুকুমার মাহিন্দার: ১৮৬৫, বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন বিদ্যাসাগর। গ্রামে কানাঘুষো ফিসফাস, বৈরাগ্য নাকি অভিমানবোধ? যাবার আগেই বিষয়-সম্পত্তি বিলি বন্দোবস্ত করে, আলাদা হেঁসেল আলাদা বাড়ি করে দিয়েছেন সকলকে। মা, স্ত্রী, ছেলের সঙ্গেই ভাই ও বোনদের মাসে মাসে অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থাও রেখেছেন। চিঠি লিখলেন পিতা ঠাকুর দাস, মাতা ভগবতী দেবী ,স্ত্রী দীনময়ী দেবী ও পুত্র নারায়ণের উদ্দেশ্যে। ক্ষোভ অভিমান এবং অব্যক্ত বেদনা ঝরে পড়লো চিঠির প্রতিটি ছত্রে।
কিছু একটা ঘটতে চলেছে এই আশঙ্কা করেই, কাশীবাসী হয়েছেন ঠাকুরদাস। পিতাকে অন্তরের গোপন ব্যথা জানিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র লিখলেন, ‘সাংসারিক বিষয়ে আমার মত হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি, কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য হইতে পারি নাই। সংসারী লোকে যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে তাঁহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার ওপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই।’
আসলে কিছুকাল যাবৎ আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী বন্ধুজন কারো সঙ্গেই আচরণে এবং বাক্যে স্বস্তি বোধ করছিলেন না । মনের ও মতের মিল খুঁজে পাননি তিনি। মন যেন জীবনের সমস্ত বাহ্যিক উৎপাত থেকে বিদায় নিয়ে নির্জনতা খুঁজছিল। তাই তিনি পরিচিত এই জগতের সঙ্গে সংস্রব রাখতে চাননি। নিভৃত এক জীবনের প্রার্থনায় তাঁর এই জন্মভূমি ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ। যা তাঁর চিঠিতে প্রকাশিত।
৫ আগষ্ট ১৮৮২ বিকেল ৪টা। দক্ষিণেশ্বর থেকে সাগর দর্শনের জন্য কলকাতার বাদুড়বাগানের দ্বিতল বাড়ির উপরের তলায় এসেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। বিদ্যাসাগরের অনেক কীর্তির কথা শুনেছেন তিনি। তাই প্রথম দর্শনের মুহূর্তে ঠাকুর বলছেন, ‘আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি এইবার সাগর দেখছি।’ বিদ্যাসাগরও রসিকতায় কম যান না। বললেন, ‘তবে নোনাজল খানিকটা নিয়ে যান’। রসরাজ শ্রীরামকৃষ্ণের ঠোঁটে তখন স্নিগ্ধ উত্তর, ‘নাগো! নোনা জল কেন? তুমিতো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর। তুমি ক্ষীরসমুদ্র’। এ যেন জহুরীর জহর চেনার গল্প। বিদ্যাসাগরের চেয়ে বয়সে ১৬/১৭ বছরের ছোট পরমহংসদেবের মুখ নিঃসৃত প্রশংসা বাক্য আজও অক্ষয় ইতিহাস।
কিন্তু বীরসিংহ বিদ্যাসাগরকে চিনতে পারল কই? এই গ্রামে ভগবতীদেবীর ইচ্ছানুসারে তিনি বিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি তৈরি করে দিয়েছেন। সারাবছর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখতেন অসহায় মানুষগুলোর জন্য। তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে উদারভাবে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য করেছেন। পাশে থেকেছেন। কিন্তু তাতেও বীরসিংহের মন পাননি তিনি। উল্টে যন্ত্রণা দিল তারা। এতটাই কৃতঘ্ন এরা (যে উপকারীর উপকার স্বীকার তো করেই না, উল্টে তার ক্ষতি করে)। বিদ্যাসাগরকে উপকারের উপযুক্ত পুরস্কার ও শিক্ষা তারা দিয়েছে বৈকি! অথচ তার বিশাল হৃদয়ে ,আর্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট জ্বালা-যন্ত্রণা ধারণ করে, নীলকণ্ঠ হলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মনের নিঃসঙ্গতা, তৃষ্ণা মেটাতে কেউ চেষ্টাও করল না। জগত সংসার শুধু হাত পেতে চাইল। তাঁর হাতে হাত কেউ রাখল না। তাই জীবনের শেষ ২৫ বছর প্রিয় জন্মভূমি বীরসিংহে আর পা রাখেননি তিনি। তীব্র অসন্তোষে জীবনের মধ্যগগনে স্ত্রী-সন্তান পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব পাড়া-প্রতিবেশীকে ত্যাগ করে বহুদূরে সাঁওতাল পরগণার কার্মাটারে সাঁওতাল পল্লীতে এক ছোট ঘরে আশ্রয় খুঁজলেন। তাদের সাঁওতালি জীবনের সরলতা সততা আর বিশ্বাসের মাঝে মনের প্রশান্তি এবং প্রকৃত হৃদয়রত্নের সন্ধান পেলেন। পেলেন মস্তিষ্কের বিশ্রাম। আধ্যাত্মিক জীবনের স্পর্শ।
স্টোমাক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন বিদ্যাসাগর । একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন তিনি। ১৮৬৫ তে উত্তর পাড়ায় হঠাৎ ঘোড়ার গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে যকৃতে আঘাত পান তিনি। শুরু হয় যন্ত্রণা। তা থেকেই ২৫ বছর পরে ধরা পড়ল এই মারণ রোগ। অনেক চিকিৎসক দেখলেন তাঁকে। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, ডাক্তার সূর্যকুমার সর্বাধিকারি, ইংরেজ ডাক্তার পামর ডাক্তার স৷লজার প্রমুখ। কিন্তু এ অসুখ যে সারবার নয়। বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।
২৯ জুলাই ১৮৯১। ১৩ শ্রাবণ ১২৯৮ বঙ্গাব্দ। মৃত্যুশয্যায় ঈশ্বরচন্দ্র। জ্বরের সঙ্গে ক্রমাগত হিক্কা। প্রবল আত্মবিশ্বাসী, সুদৃঢ় চরিত্রের অধিকারী এই মানুষটি মাঝেমধ্যেই জ্ঞান হারাচ্ছেন। কঠিন রোগ যন্ত্রণার ছাপ চোখে মুখে শরীরের সর্বত্র। হঠাৎ ফিরে পেলেন জ্ঞান। মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন ফুলমালা সজ্জিত মা ভগবতীদেবীর ছবির দিকে। যেন শুনতে পেলেন মা ডাকছেন, ওরে ঈশ্বর ঘরে ফিরে আয় বাবা…।
২৫ বছর আগে পুত্রের গৃহত্যাগের পরে বুক চাপড়ে যেভাবে কাঁদতেন ভগবতীদেবী, সেই কণ্ঠস্বর আবারও শুনলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তিনি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, মাগো বীরসিংহে ফিরে যাইনি দুঃখে, অভিমানে, যন্ত্রণায়। কিন্তু আজ তোমার কোলে মাথা রেখে, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাই আমি। আমার এই ক্লান্ত, জীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে তোমার কোলে তুলে নাও মা।
৭১ বছর বয়সে চলে গেলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এই লৌকিক কর্মভূমি ত্যাগ করে, চললেন পরলোকের পূণ্যভূমিতে। যেখানে তাঁর আর কোনও ক্ষোভ, অভিমান, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা কিছুই নেই। আছে শুধু মা ভগবতীদেবীর প্রশস্ত মাতৃকোল। যা জগতের প্রতিটি সন্তানের পরম আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির আশ্রয়। শান্তির নীড়। স্নেহের কোমল স্পর্শ।
Home এই মুহূর্তে বিশেষ প্রতিবেদন বৈরাগ্য নাকি অভিমান? বীরসিংহ ত্যাগ করলেন বিদ্যাসাগর …’ওরে ঈশ্বর…, ঘরে ফিরে আয়...