ক্রাক্স অরুণাভ মাইতি
আমার বুকের একটা হরক্রাক্স তোর বুকে রাখলাম।হোলির লালচে গাল, আবির আর পিচকিরির রং মাখানো বাতাসের সাথে ফিসফিস করে বলেছিলো তৃষ্ণা।হরক্রাক্স আবার কি?তুই এখনকার ছেলে না প্রস্তরযুগের? হরক্রাক্স হলো আত্মার একটা টুকরো যা থেকে জাদুবলে আবার জীবন লাভ করা যায়।হ্যারি পটারে লর্ড ভল্ডেমর্ট নিজের সাতটা হরক্রাক্স বানিয়েছিলো।আর আমি তো মাত্র একটাই বানালাম।শুধু একটাই।বুঝলি হাঁদারাম।পলাশ সত্যি সত্যি হাঁদা হয়ে গেলো।রঙের আক্রমণে জেরবার তাকে যে একজোড়া নরম উচ্ছল ঠোঁটও আক্রমণ করবে তা সে কল্পনাও করেনি।সে গোহারান হেরে আত্মসমর্পণ করলো।তারপর পাড়ার মোড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছটা অনেকবার লাল হয়েছে।
পলাশ কিন্তু জীবনের দৌড়ে তাল মেলাতে মেলাতে অন্য অনেকের সাথেই আর তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি।সে এখন ইউ এস এর ডিট্রয়েটে থাকে।গ্রীন কার্ড হোল্ডার।আর পেশায় ট্যাক্সি ড্রাইভার। গ্রীন কার্ড টা মার্থার কল্যাণে।মার্থা ম্যাকক্লিনেগান তার স্ত্রী। অনেক হিসেব কষে বিয়েটা করেও এখন আর হিসেব ঠিক রাখতে পারছে না পলাশ।মাদকতাময় মার্থা হিউসটনের একটা পাবে কাজ করতো।স্কলারশিপ পেয়ে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আমেরিকায় আসা পলাশের চোখে তখন দ্রুত স্বর্গে পৌঁছোনোর তাড়া।তাদের ডেটিং,বিয়ে,ছোট্ট হ্যালির জন্ম সব ঝড়ের বেগে হয়ে গেলো।কিন্তু সদ্যজন্মানো মেয়ে,লং ডিসট্যান্ট দাম্পত্য,আর ঝড়ের মতো মার্থাকে সামলাতে সামলাতে পড়াশোনাটা আর হয়ে উঠলো না পলাশের।ফলে সে এখন আমেরিকার গ্রীনকার্ড হোল্ডার ট্যাক্সি ড্রাইভার।
অ্যাম্বাসাডর ব্রিজের ওপর দিয়ে ক্যাব চালাতে চালাতে মাঝেমধ্যে পলাশের ইচ্ছে হয় তার ক্যাবসহ মিশে যায় ডিট্রয়েটের নীল কালো জলে।হয়তো নীল শান্তি ওখানেই আছে! কিন্তু ছোট্ট হ্যালির কথা ভেবে শেষপর্যন্ত তা সে করতে পারে না।মার্থার সাথে তার মিউচুয়াল ডিভোর্সের লাস্ট হেয়ারিং আগামীকাল। পলাশ আর পারছে না।ভারতবর্ষের কথা, তার রূঢ়ভাবে পর করে আসা বাবা- মা- ভাই, স্বজন, সুজনদের কথা মনে পড়ে।গতজন্মের স্বপ্নের মতো মনে হয় সব।নাহ, সে দেশেই ফিরে যাবে।আজ, বারোটা বসন্ত পেরিয়ে গেলো…
চাঁদের হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে হাঁটছিলো পলাশ।দশবছরের হ্যালির আঙুল ধরে।আনমনাভাবে।নিজের দেশে ফেরাটা খুব একটা সুখকর হয়নি তার।ছোটভাই অশোক তার দিকে পাথরের মতো তাকিয়ে ছিলো।গঞ্জের বাজারে মাঝারিগোছের একটা মুদিখানা দোকান দিয়েছে সে।ছবছরের একটা বাচ্চা, খাটুনে শান্ত একটা বউ নিয়ে সুখী সংসার তার।হঠাৎ করে ভুলে যাওয়া এক ভাগীদার এসে জোটায় স্পষ্টতই খুশি নয় ।নওল অশোকের ক্ষুদে পুত্রসন্তান। সে তার পিটপিটে অবাক চোখ নিয়ে তাকিয়েছিলো ধবধবে ফর্সা হ্যালির দিকে।সবচেয়ে বড়ো ধাক্কাটা পলাশ পেলো তার বাবার কাছ থেকে।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন।এসেছো ভালো।সপ্তাহখানেক থাকো।কিন্তু পাকাপাকিভাবে থাকতে হলে নিজের জন্যে জায়গা খুঁজে নিও।ভদ্রভাবে গলাধাক্কা।কিন্তু এটা তার পাওনা ছিলো। মা-ই শুধু তার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলো।আর সেও কাঁদছিলো।ভেতরে ভেতরে…
“ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল,লাগলো যে দোল”… একঝাঁক কচিকাঁচা গলার ঝঙ্কারে চিন্তাচ্ছন্ন ভাবটা ভেঙে গেলো পলাশের।প্রার্থনা সঙ্গীত নয় তো এটা! ও, আগামীকাল যে দোল।
বসন্তোৎসবের প্রস্তুতি চলছে।হঠাৎ করে একটা সুরেলা আর পরিণত মেয়েলি গলা আচ্ছন্ন করে ফেললো পলাশকে…”রাঙাহাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে/ রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে”…কোথায়, কোথায় যেন শুনেছিলো সে এই প্রিয় কণ্ঠস্বর? মেয়ের হাতটা মুঠোয় আঁকড়ে এলোমেলো পলাশ পায়ে পায়ে ঢুকে পড়লো চাঁদের হাট প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে। দেখলো একটা রাঙা কৃষ্ণচূড়ার তলায় একঝাঁক ছেলেমেয়েদের গানের রিহার্সাল করাচ্ছেন এক দিদিমণি। দিদিমণির চোখে চশমা, পরনে সবুজ পাড় সাদা শাড়ি।কপালে, না কপালে কোনো লাল রেখা নেই! গালের টোলটা বড়ো প্রিয়, বড়ো চেনা।দিদিমণিও দেখতে পেলেন। এগিয়ে এলেন।হ্যালির ছোট ছোট হাতগুলো হাতের মুঠোয় নিলেন।কিছু বলতে যাবেন।কিন্তু তাঁর চশমা খুব ঝাপসা হয়ে এসেছে।কাঁচগুলো মুছে ফেলা দরকার!
অনেক কষ্টে বুকের মধ্যে বাতাস সঞ্চয় করে পলাশ বললো। আমি আমার হরক্রাক্স গুলো আর কখনো খুঁজে পাবো না। আমার বাবা, মা, ভাই, বন্ধু আর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেই সেগুলো আমি হারিয়ে ফেলেছি।কিন্তু তোর হরক্রাক্সটা আমি বুকের ভিতর আগলে রেখেছি।তুই ওটা নিয়ে নে।আর আমাকে ক্ষমা করে দে।আমি কখনোই তোর যোগ্য ছিলাম না।সেটা আমি প্রথম দিন থেকেই জানতাম, ছদ্ম গাম্ভীর্যে তৃষ্ণা বললো।ঠিক আছে। আমার হরক্রাক্স আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।বলেই সে হ্যালির ছোট্ট হাতটা আঁকড়ে তার ছেলেমেয়েদের ঝাঁকে ফিরে গেলো।হতভম্ব, বাষ্পীভূত পলাশ দেখলো একঝাঁক ছোট্ট কুঁড়ির ভিড়ে মিশে তার হ্যালিও এবড়োখেবড়ো উচ্চারণে গাইছে… “নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল, দ্বার খোল দ্বার খোল”…
আপনার মতামত সরাসরি অরুনাভ মাইতে কে জানাতে পারেন +91 98746 55785 নাম্বারে।