‘দাসপুরে শতাব্দী প্রাচীন ষড়ভুজ শ্রীচৈতন্য আরাধনা’ —উমাশংকর নিয়োগী
♦মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের বহু পূর্ব থেকে বাংলায় রাধাকৃষ্ণতত্ব প্রচলিত ছিল। শক্তি সাধনার তীর্থ ক্ষেত্র বীরভূম হলেও কেঁদুলিতে জয়দেব গোস্বামী তাঁর ‘গীতগোবিন্দ ‘ রচনা করেছেন। সরল সংস্কৃতে লেখা ‘গীতগোবিন্দ ‘ বাংলার ঘরে ঘরে সমাদৃত হয়েছে। প্রাকচৈতন্য জয়দেব, বড়ুচণ্ডীদাস , চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতির পদাবলী রসাস্বাদনে বাঙালি অভ্যস্ত ছিল। পরবর্তী কালে রাধাকৃষ্ণের উপাসনা রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তিধর্মের প্রভাব ব্যাপকভাবে উড়িষ্যা সহ সারা বাংলাদেশ ছড়িয়ে পড়ে। শ্রীচৈতন্যের হরিনাম সংকীর্তন আর নৃত্যে কেবল শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়নি, সারা বাংলা ভেসে গিয়েছিল। শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে দাসপুরের প্রায় প্রতিটি মন্দিরে যেমন সপার্ষদ শ্রীচৈতন্য ও কৃষ্ণলীলার কাহিনি স্থান পেয়েছে তেমনি আছে গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রের বাহুল্য। গায়কের মধ্যে কীর্তনীয়া আছেন আছেন ধ্রুপদী গায়ক। মহিলা গায়িকা এবং বাদ্যকরও স্থান পেয়েছে মন্দির স্থাপত্যে।
শালগ্রাম শিলায় শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী বিষ্ণু কল্পিত হয়ে বিভিন্ন নামে পুজো হয় দাসপুরের সর্বত্র। পরবর্তী কালে চৈতন্যদেবের প্রভাবে বিষ্ণু কৃষ্ণ অভেদ রূপে পূজিত হতে থাকেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রভাবে বাসুদেব ক্রমে মানুষের কাছে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি স্বরূপ পূজিত হতে থাকেন । কালক্রমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিতে পরিবর্তিত হয়ে আরাধ্য হয়েছেন ।
শোনা যায় মেদিনীপুর জেলা শ্রীচৈতন্যের পদধূলি ধন্য জেলা। তাঁর কৃষ্ণপ্রেমভক্তি সাধনধারা প্রবাহে সারা দেশের মত দাসপুরও ভেসে ছিল । এক সময়ে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি শাখা চৈতন্যকেই রাম ও কৃষ্ণ রূপে কল্পনা করে পুজো শুরু করেন । পরবর্তী কালে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের নির্দেশে কৃষ্ণ প্রাপ্তির উপায় স্বরূপ চৈতন্যকে নির্দিষ্ট করলে চৈতন্য প্রভাব ক্রমে নিম্নমুখী হতে থাকে। চৈতন্য জীবনীকারেরা চৈতন্যের মধ্যে কৃষ্ণের লীলামাধুরী খুঁজে বেড়িয়েছেন। নরোত্তম দাসের ‘ চৈতন্য মঙ্গল’ থেকে জানা যায় বাসুদেব সার্বভৌম নীলাচলে প্রথম চৈতন্যের ষড়ভুজ মূর্তি দর্শন করেছেন । —“ হেনই সময়ে প্রভু ষড়ভুজ শরীর । / দেখি সার্বভৌম হইল আনন্দে অস্থির ।।/ ঊর্ধব দুই হাতে ধরে ধনু আর শর। / মধ্যে দুই হাতে ধরে মুরলী অধর ।।/ নিম্ন দুই হাতে দণ্ড কমণ্ডল । / দেখি সার্বভৌম হইল আনন্দে বিহ্বল।। ” এছাড়াও নবদ্বীপে শ্রীবাস , কাশী মিশ্র প্রমুখ গৌরাঙ্গের ষড়ভুজ রূপ দেখেন। রাম, কৃষ্ণ ও গৌরাঙ্গের মিলিত বিগ্রহ ষড়ভুজ চৈতন্য । উপরের দুই হাতে রামচন্দ্রের ধনুর্বাণ , মধ্যের দুই হাতে কৃষ্ণের মুরলী ও নীচের দুই হাতে চৈতন্যের সন্ন্যাসের প্রতীক দণ্ড কমণ্ডুলু ।
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে শ্যামরায় ( ১৬৪৩ খ্রিঃ ) কেষ্টরায় ( ১৬৫৫ খ্রিঃ ) এবং মদনমোহনের ( ১৬৯৪ খ্রিঃ ) মন্দির গাত্রে ষড়ভুজ চৈতন্যের মূর্তি দেখা মিললেও দাসপুরে সিংহদের গোপীনাথের ( ১৭১৬ খ্রিঃ) মন্দিরে প্রথম ষড়ভুজ চৈতন্যের টেরেকোটার ফলক দেখা যায়। এছাড়া চাঁইপাটের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে ( ১৭৯৮ খ্রিঃ ) কোটালপুরে ভূঁইয়াদের শ্রীধরের পঞ্চরত্ন মন্দিরে ( ১৮১৫ খ্রিঃ) অতিসম্প্রতি কোটালপুরের টেরেকোটা সমস্ত ফলক ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে । গোছাতির মাইতিদের সন তারিখহীন সতেরো চূড়া রাসমঞ্চের পূর্বদিকে দাসপুরের সবথেকে বড় পোড়ামাটির ষড়ভুজ চৈতন্য আছে , কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ধর্মোন্মাদদের বিকৃত মানসিকতায় দাসপুরের বহু মন্দিরের মত এখানেও মূর্তির মুণ্ডটি ভাঙা হয়েছে । সামাটের মদনগোপাল দালানে ( ১৮২৮ খ্রিঃ ) আজুড়িয়ার চরণদের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে (১৮৭১ খ্রিঃ) রামদাসপুরে দুর্গাপদ মাইতিদের দধিবামন পঞ্চরত্ন (১৮৩৪ খ্রি: ) পূর্বমুখী মন্দিরের মূল রত্নে, নাড়াজোলের রাজবাড়ির জয়দুর্গা মন্দিরে , শ্রীধরপুরে সামন্তদের রঘুনাথের দরজার বাম দাঁড়াতে ষড়ভুজ চৈতন্যের খোদিত মূর্তি আছে।
কেবলমাত্র মন্দির ফলকে নয়, তিনশতাধিক বছরের বহু পূর্ব থেকে নিমতলার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সম্প্রদায়ের অস্থলে দারুমূর্তি ষড়ভুজ চৈতন্য সপার্ষদ পূজিত হয়ে আসছেন। নিমতলারই তমাল হড় গোস্বামীর বাড়িতেও দারুমূর্তি ষড়ভুজ চৈতন্য , নিত্যানন্দ ও ষড় গোস্বামী নিত্য আরাধিত হচ্ছেন। নাড়াজোল রাজবাড়ির অদূরে ভূইঞাদের প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন মন্দিরে ষড়ভুজ চৈতন্য আরাধিত হচ্ছেন । ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে বৈষ্ণবগুরু শ্যামানন্দ নাড়াজোলে আসেন এবং শ্রীপাট- গোপীবল্লভপুরের অধীনস্থ মদনমোহন অস্থলের প্রতিষ্ঠা করেন । তারপরে এই পঞ্চরত্ন মন্দির নির্মিত হয় । মদনমোহন , রাধাকৃষ্ণ , গোপাল , ষড়ভুজ চৈতন্যের দারুবিগ্রহ ইত্যাদি মূর্তির আরাধনা আরম্ভ হয় । বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া থানার বৃন্দাবনচক গ্রামে যে ধাতুমূর্তি ষড়ভুজ চৈতন্য উপাসিত হচ্ছেন তাঁর আদি অবস্থান ছিল দাসপুরেই ।
কিংবদন্তি অনুসারে নাড়াজোল রাজবংশের সূচনার বহু পূর্বে রাজনগরের নিকটবর্তী আনন্দগড়ে এক রাজাবংশের রাজত্ব ছিল । তাদের গড়ের ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখা যায় । এই রাজার সভাকবি হিসেবে স্বীকৃতি পান হুগলির বোরলডাঙি থেকে আগত মুকুন্দরাম নন্দ । রাজ অনুগ্রহে তিনি এক প্রহরের জন্য রাজা হয়েছিলেন । তাঁর পদবি হয় ‘ প্রহরাজ’। তাঁর ভদ্রাসন ছিল হোসেনপুরে । পাণ্ডিত্য , নিষ্ঠা , শ্রীকৃষ্ণে প্রগাঢ় ভক্তি দেখে এই প্রহরাজদের বংশ পরম্পরার কাছে বহু মানুষ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পেই সুবাদে এঁদের পদবি গোস্বামী হয়ে যায় । রাধাবল্লভের পুত্র রাসানন্দ গোস্বামীর সময়কালে , ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে শিবপ্রসাদ চৌধুরী তাঁর গুরুগৃহ হোসেনপুরে গোপীনাথের পঞ্চরত্ন মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন । রাসানন্দের এক প্রিয় শিষ্য বাঞ্ছারাম থাকতেন বৃন্দাবনচক গ্রামে । যে কোন কারণেই হোক না কেন রাসানন্দ এই প্রিয় শিষ্যের অনুরোধে ১৩১৭ সালে , ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে হোসেনপুর ছেড়ে বৃন্দাবনচকে চলে যান । সঙ্গে নিয়ে যান গোপীনাথ, রাধারানি , নৃসিংহ শালগ্রামশিলা সহ অন্যান্য দেবতা । বাড়কাশিমপুরে এই গোস্বামী বংশের পুরুষ জনৈক গোপীনাথ গোস্বামী বসবাস করতেন । তাঁর বাড়িতে আরাধিত হতেন ধাতু নির্মিত ষড়ভুজ চৈতন্য । কোন এক সময়ে সেবা চালাতে অপারক হলে তিনি রাসানন্দকে ষড়ভুজ চৈতন্য বিগ্রহ দেয়ে দেন । হোসেনপুরেই এই বিগ্রহ উপাসিত হতেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে বাড়কাশিমপুরে কালীকিঙ্কর চক্রবর্তীদের বাস্তুর পাশেই গোপীনাথ গোস্বামীর বাস্তু ছিল। বর্তমানে গোস্বামী বংশের কেউ বাড়কাশিমপুরে থাকেন না । রাসানন্দ হোসেনপুর ছেড়ে যাওয়ার সময় অন্যান্য বিগ্রহের সাথে ষড়ভুজ চৈতন্যকেও নিয়ে যান । এই বিগ্রহটি এখন বৃন্দাবনচকে নিত্য আরাধিত হচ্ছেন । মূর্তিটি দাসপুরে আরাধিত হওয়া একটি বিরল ষড়ভুজ চৈতন্যের ধাতুমূর্তি ।
কাদিলপুরে দত্তদের মন্দির(১৮০০ খ্রিঃ) পোড়ামাটির ফলকে গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ সহ ষড় গোস্বামীর দেখা মিলবে। সামাটের অস্থল,চাঁইপাটের রাধাগোবিন্দ মন্দির, দাসপুরে পালেদের মন্দির,লাওদার বালিয়ালদের মন্দিরে , শ্রীধরপুরে সামন্তদের মন্দিরে , চাঁইপাটের রাজরাজেশ্বর মন্দির সহ অন্যান্য বহু মন্দিরে গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ দেখা যাবে। বাসুদেবপুরের চক্রবর্তীদের মহাপ্রভু নবরত্ন মন্দির (১৮৩২ খ্রিঃ ) সাম্প্রতিক কালে ধ্বংস সাধন করা হয়েছে কেবল গৌরাঙ্গের দারু বিগ্রহ পূজিত হচ্ছেন ।
রবিদাসপুরের অধিকারীদের কৃষ্ণবলরাম মন্দিরে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির কৃষ্ণ বলরামের দারুমূর্তি দ্বয় চৈতন্য প্রভাব এড়িয়ে আজও আরাধিত হয়ে চলেছেন। জয়রাম চকের শ্রীমন্দিরে রাধা কৃষ্ণসহ গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ, বড় শিমুলিয়ার আনন্দ আশ্রমে রাধাকৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ, গৌরার গৌরগোপাল ধামে নাড়ুগোপাল , সেকেন্দারীর রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে , পদমপুরে গুঁইদের নন্দদুলাল মন্দিরে , সাগর পুরে রাধামাধবের মন্দির ইত্যাদিতে। সুদীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা রাধাকৃষ্ণ সহ গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দের আরাধনা দাসপুরের শ্রীকৃষ্ণ ও চৈতন্য আরাধনার ধারাবাহিকতার উজ্জ্বল নিদর্শন ।
যাঁরা মন্দিরময় দাসপুরে দেড়শতাধিক বৎসরেরও পূর্বে মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বর্তমানে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের অধিকাংশের মন্দির সংস্কারের মত আর্থিক সামর্থ্য ও মানসিকতা নেই । অধুনা দাসপুরের যত্রতত্র বিপুল অর্থব্যয়ে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন , নরনারায়ণ সেবা হয় । এঁরা তাঁদের ব্যয়ের সামান্য অংশ দান করলে আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য স্বরূপ শ্রীচৈতন্যের ফলক যুক্ত মন্দিরগুলিকে আরও শতাধিক বৎসর অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে পারা যায় ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: •গৌরদাস গোস্বামী, ধ্যানচন্দ্রদাস গোস্বামী।বৃন্দাবনচক, পূর্ব মেদিনীপুর। •রঞ্জন মাইতি নাড়াজোল। •ঘাটালের কথা পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও প্রণব রায়। •ঘাটাল মহকুমার দর্শনীয় স্থান ড . পুলক রায়।