সুব্রত বুড়াই [গোমকপোতা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। সাপ নিয়ে দীর্ঘদিন সচেতনতামূলক প্রচারের কাজ করছেন। সর্প দর্শন এবং হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে সমস্যায় পড়লে সরাসরি যোগাযোগ করা যাবে ৯৭৩৩৬৯৬৯১৬ এই নম্বরে।]: সাপের কামড়ে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মৃত্যুর হার কমানোর উদ্দেশ্যে যে সব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেই বিষয়ে পাঠকগণের চিন্তাভাবনাতে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলার জন্যই এই লেখার অবতারণা। পশ্চিমবঙ্গে গ্রামের সংখ্যা বর্তমানে ৩৭,৯৪৫ টি। আমাদের এই গ্রামবাংলায় বসবাসকারী মানুষেরাই সাপের কামড়ের দ্বারা বেশি আক্রান্ত হন। আবার আক্রান্তদের বেশির ভাগই কৃষক, ক্ষেতমজুর, দারিদ্র সীমার নীচে থাকা গ্রামে বসবাসকারী মানুষ। এদের বেশির ভাগ মানুষের ভালো ঘরবাড়ি নেই। ঘরবাড়ি থাকলেও বসবাসযোগ্য ঘরের পাশে গবাদিপশু, খাদ্য শস্য থাকার মজুতঘর ইত্যাদি থাকার কারণে সাপের আনাগোনার ঘটনা ঘটে।
গ্রামবাংলায় সাধারণত গোখরো, কেউটে, কালাচ এবং চন্দ্রবোড়া নামক চারটি বিষধর সাপের কামড়ের দ্বারা বেশি আক্রান্ত হন গ্রামবাসীরা। এখনও পর্যন্ত আক্রান্ত মানুষদের সচেতনতার অভাবে বহুসংখ্যক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর সরকারি হিসাবে ৮৫০ জন মানুষ মারা যান সাপের কামড়ে। সমগ্র ভারতের নিরিখে সংখ্যাটি ৫৬,০০০। মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিবছর এই বিপুল সংখ্যায় গ্রামের মানুষই মারা যান। সর্প বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখিয়েছেন, সারাভারতে প্রায় ২৭০ টি প্রজাতির সাপ দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যাটি হল ১০০। পৃথিবীতে ১২.৮ কোটি বছর আগে ক্রিটেশিয়াস যুগে প্রথম সাপের উদ্ভব হয়। সাপেরা সাধারণত মাটির গর্তে, জলে অথবা গাছে বসবাস করে। সাপ অত্যন্ত নীরিহ প্রাণী। এদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। কিছু গাছে বসবাসকারী সাপের দৃষ্টিশক্তি খুব ভালো হয়। সাপের ত্বক অনুকম্পনে সংবেদনশীল। মানুষ সাপের খাদ্য নয়। আত্মরক্ষার তাগিদেই সাপ মানুষকে কামড়ে দেয়। এদের কোনও বহিঃকান বা কানের পর্দা নেই। গ্রামবাংলার যে চারটি বিষধর সাপ তথা গোখরো, কালাচ, কেউটে ও চন্দ্রবোড়া কামড়ালে প্রাণহানি ঘটতে পারে সেই প্রসঙ্গে কিছু বিষয় জেনে রাখা দরকার।
•গোখরো বা স্পেক্টাক্লেড কোবরা: এটি ফণাযুক্ত সাপ। এদের বিষ নিউরোটক্সিক। গোখরো সাপের ফণার পেছনে ইংরেজি ইউ অক্ষরের মত একটি চিহ্ন থাকে। একে খড়ম চিহ্নও বলে। গোখরো সাপের কামড়ের লক্ষণ হল, প্রচণ্ড ব্যথা অনুভবের পাশাপাশি কামড়ানো জায়গাটি ক্রমবর্ধমানভাবে ফুলতে থাকবে।
•কেউটে বা মনোক্লেড কোবরা: কেউটের ফণার পেছনে পদ্ম চিহ্ন থাকে। এই নিউরোটক্সিন সাপের কামড়ে রোগী ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়বে। দুটি চোখের পাতা পড়ে আসবে। ঝাপসা দেখার পাশাপাশি রোগীর কথা জড়িয়ে যাবে।
•কালাচ বা কমন ক্রেট: কালাচ একটি ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ। ফণাহীন মাঝারি চেহারার এই সাপটির গায়ের রং কুচকুচে কালো। কালোর ওপর সরু সরু সাদা ব্যান্ড বা চুড়ি লেজের শেষ পর্যন্ত থাকে। এরা রাতের বেলা ঘোরাফেরা করে। প্রায় দেখা যায় খোলা বিছানায় রাতে শুয়ে থাকা অবস্থায় এরা কামড়ায়। এদের কামড়ে কোনও ব্যাথা অনুভব হয় না। বা জায়গাটি ফুলেও ওঠে না। এর সুক্ষ্ম কামড়ের দাগ খুঁজেই পাওয়া যায় না। কামড়ের দু’ঘণ্টা থেকে ২০ ঘণ্টা পরেও এর লক্ষণ মিলতে পারে। এর কামড়ে জ্বালা বা যন্ত্রণা হয় না। কালাচ কামড়ালে যে উপসর্গগুলি দেখা যায় সেগুলো হল, পেটে ব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, খিঁচুনি ও দু চোখের পাতা পড়ে আসা।
•চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপার: চন্দ্রবোড়া একটি হিমোটক্সিক সাপ। চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে বেশি মানুষ মারা যায়। বাদামী বর্ণের এই সাপটি চেহারায় মোটা এবং গায়ে হলুদ বর্ণের চাকা দাগ থাকে। এর কামড়ে প্রাথমিকভাবে ব্যথা অনুভব হয় ও জায়গাটি ক্রমবর্ধমানভাবে ফুলতে থাকে। পরে দাঁতের মাড়ি, পুরানো ঘা বা কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া শুরু হয়। চন্দ্রবোড়ার কামড়ে রক্ত তঞ্চন ব্যাহত হয়। চিকিৎসায় দেরি হলে কিডনি নষ্ট হয়।
এছাড়া উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে শঙ্খচূড় বা কিং কোবরা নামক বিষধর সাপ দেখা যায়। অন্যান্য বিষধর সাপের মধ্যে শাঁখামুটিও উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গে বিষহীন সাপগুলির মধ্যে অন্যতম হল, ঘরচিতি বা চিতিবোড়া, কাল নাগিনী, দাঁড়াশ, লাউডোগা, তুতুর, লালবালি বোড়া, হেলে বা হলহলে সাপ, সবুজ কাঁড়সাপ বা বেড়াল চক্ষু সাপ, কুকরি সাপ বা উদয়কাল, মেটালি বা কানামেটালি, বেত আছড়া, অজগর জলঢোঁড়া ইত্যাদি।
অনেক সময় সাপ কামড়ালে কামড়ের পর তা নজরেই আসে না। আবার অনেক সময় কামড়ের পর সাপটিকে লক্ষ্যও করা যায়।
কোনও ব্যক্তিকে সাপ কামড়ালে তিনি ও তার পরিবার-পরিজন যা করবেন এবং করবেন না—
১) ওঝার কাছে যাবেন না। ২) সামনাসামনি হাসপাতাল থাকলে সেখানে যেতে হবে যেখানে সাপের কামড়ের চিকিৎসার ওষুধ অ্যান্টিভেনম সিরাম, অ্যাট্রপিন, নিওস্টিগামিন, অ্যাড্রেনালিন পাওয়া যায়। ৩) রোগীকে আশ্বস্ত করবেন। অযথা আতঙ্কিত হবেন না। ৪) রোগীকে নড়াচড়া করাবেন না। ৫) ১০০ মিনিটে ১০ টি অ্যান্টিভেনম নিতে হবে, তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে যাবেন। সাপ কামড়ানোর চিকিৎসায় প্রথম ১০০ মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৬) হাসপাতাল গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। ৭) কামড়ানো স্থানটিতে কোনও বাঁধন না দেওয়াই ভাল।
৮) মোটরসাইকেল ব্যবহার করবেন। মোটরসাইকেল চালক, মাঝে রোগী এবং পেছনে একজন রোগীকে ধরে বসবেন। রোগীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাসপাতালে যাবেন। ৯) কামড়ের স্থানে কোনও ফার্স্ট এড না ব্যবহার করাই ভাল।
১০) হাসপাতালে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলবেন। ১১) ডাক্তারবাবু রোগীকে রেফার করলে রোগীকে কোন হাসপাতালে রেফার করলেন তা ভালো করে জেনে তবেই যাবেন।
সাপের কামড়ের চিকিৎসার উন্নত ব্যবস্থাপনা চাই: বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব্লক হাসপাতাল বা তার অন্তর্গত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মহকুমা হাসপাতাল, জেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম সিরাম সহ অন্যান্য ওষুধ বিনামূল্যে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সমগ্র ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই এই ব্যবস্থাপনা আছে। গোখরো, কালাচ, বা কেউটে কামড়ালে প্রয়োজনীয় ঔষুধপত্রের পাশাপাশি রোগীর অবস্থার উপর নজর রেখে দরকারে তাকে ভেন্টিলেশন দিতে হয়। অন্যদিকে চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের পর রোগীকে ডায়ালিসিস করার প্রয়োজন পড়ে।
আর তখনই ডাক্তারদের রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠাতে হয় যেখানে ভেন্টিলেশন বা ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা আছে। এই আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রামবাংলার ব্লক হাসপাতালগুলিতে নেই।
অনেক মহকুমা হাসপাতালে ভেন্টিলেশন ও ডায়ালিসিস ব্যবস্থা থাকলেও সব হাসপাতালে এই ব্যবস্থা নেই। তাই রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর সময় অনেক রোগীর মারা যায়।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য বেশিরভাগ মানুষ দাবি তুলুন যে গ্রামবাংলার মানুষকে সাপের কামড়ের হাত থেকে বাঁচাতে তার সঠিক চিকিৎসার জন্য ব্লক বা মহকুমা হাসপাতালগুলিতে ভেন্টিলেশন বা ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা হোক। সংশ্লিট ব্লকের ও মহকুমার জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনিক আধিকারিকরা যদি সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেন তবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্রায় ১২ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের বন্যপ্রাণী দফতর বিষধর সাপের বিষ সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছেন। ফলে বাংলায় যে অ্যান্টিভেনম সিরাম আসে তা দক্ষিণ ভারতের সাপের বিষ থেকে তৈরি। যা গোখরো, কেউটে, কালচের ক্ষেত্রে ভালো কাজ করলেও চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে নানারকমের সমস্যা তৈরি করছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের বিষধর সাপের বিষ সংগ্রহের অনুমতি প্রদানের জন্য সংশ্লিট দফতরের নিকট আবেদন করা প্রয়োজন। এই গুরুত্বপূর্ণ অনুমতি প্রদানের বিষয়টি বিধায়ক ও সাংসদদের আন্তরিকতার সঙ্গে দেখতে হবে।
পোলিও ও ডেঙ্গু রোগ যদি জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচির অন্তর্গত হয় সেক্ষেত্রে প্রতিবছর যে বিপুল সংখ্যক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছেন সেই বিষয়টি মাথায় রেখে সাপের কামড়ের বিষয়টিও স্বাস্থ্যকর্মসূচির আওতায় আনা প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে সমস্ত মানুষের পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদেরও সদর্থক ও তৎপর ভূমিকা নিতে হবে। এছাড়া সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার কমাতে প্রতিবছর গ্রামীণ এলাকার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক প্রয়োজন। এছাড়া সমগ্র পূর্ব ভারতে কোথাও অ্যান্টিভেনম সিরাম উৎপাদনের ল্যাবরেটরি নেই। সেই সঙ্গে সাপ কামড়ের চিকিৎসার উপর উন্নত কোনও গবেষণাগার নেই বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনও গবেষণাও পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে বিষধর সাপের বিষ সংগ্রহ করে যাতে এ রাজ্যেই সিরাম উৎপাদন করা হয়, সেই বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে আবেদন রাখতে পারি। সাধারণ মানুষের দাবি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনিক আধিকারিকরা যদি বিষয়টি সহৃদয়তার সঙ্গে দেখেন তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সাপ কামড়ের চিকিৎসায় অদ্ভুতপূর্ব পরিবর্তন আসবে, ফলে গ্রামবাংলায় সাপের কামড়ে মৃত্যুর হারও কমানো সম্ভব হবে। আমাদের সবার উদ্দেশ্য হোক, সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা। বিষধর সাপের বিষ থেকেই এন্টিভেনম সিরাম তৈরি হয়। সাপ আমাদের বন্ধু। আমরা ওই নিরীহ প্রাণীটিকে মেরে ফেলব না। সাপ সংরক্ষণে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। আমরা সচেতন থাকলে সাপের কামড় এড়াতে পারি। সে জন্য গ্রামের মানুষদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। •নীচের ভিডিও’র দেখে সাপ চিনুন।