কেয়া মণ্ডল চৌধুরী
আমার কলম ঘাটাল মহকুমার জীবনবোধের শরিক। আমি সামাজিক সমস্যার নিভৃত কান্না, অভাবের নীরব দীর্ঘশ্বাস এবং সাধারণ মানুষের গভীর অভিযোগের সুর শুনতে ভালোবাসি। আমার লেখনি আলো-আঁধারের গাঢ় পটভূমি এড়িয়ে চলে। খুন-খারাপি, রাজনৈতিক জটিলতা বা তীব্র দুর্ঘটনার মর্মান্তিক দৃশ্য আমার উপজীব্য নয়। আমি ডুব দিই লোকায়ত জীবনের সরল জটিলতায়—ঘাটালের ধূলিকণা ও মানুষের আশা-হতাশা—এরাই আমার লেখনির প্রাণ। যা আমি ‘স্থানীয় সংবাদ’-এর মাধ্যমে তুলে ধরি।
কেয়া মণ্ডল চৌধুরী, ‘স্থানীয় সংবাদ’, ঘাটাল: রাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় মেলা ‘ঘাটাল উৎসব ও শিশু মেলা’র নাম এবং মেলার উদ্দেশ্যের পরিবর্তন নিয়ে সম্প্রতি তীব্র বিতর্কের মুখে পড়েছে। এই মেলাটি শুরুতে ‘শিশু মেলা’ নামে পরিচিত হলেও পরবর্তীকালে ওই নামের সঙ্গে ‘ঘাটাল উৎসব’ শব্দবন্ধটি যুক্ত হয়ে এর নাম হয় ‘ঘাটাল উৎসব ও শিশু মেলা’। যদিও সারা মহকুমা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা এখনও পুরানো অভ্যাসবশত মেলাটিকে ‘শিশু মেলা’ই বলেন। কিন্তু অভিযোগ উঠছে, বর্তমানে এই মেলাটি শিশুদের আবেগ ও ভালোলাগার বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করে বড়দের বিনোদনমূলক মেলায় পরিণত হয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ, বিগত ২০-২৫ বছরে মেলা কর্তৃপক্ষ মেলার মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন।
সালটা ছিল ১৯৯০। শহরের দুই জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী অশোক সামন্ত এবং সঞ্জয় রায় কোলাঘাট এলাকায় একটি শিশু মেলার পোস্টার দেখে ঘাটাল রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকারকে ঘাটাল শহরেও ওই ধরনের একটি মেলা করার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৯০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঘাটাল বিদ্যাসাগর স্কুল মাঠে ‘শিশু মেলা’র সূচনা হয়। তখন মেলার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র একদিন। মেলাটির প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তা ছিল সঞ্জয় রায় এবং অশোক সামন্তের অঙ্কন স্কুল ‘নন্দন কলা কেন্দ্র’। প্রথম শিশু মেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন ঘাটালের তৎকালীন এসডিও সুন্দর মজুমদার। প্রথম বছরের কর্মকর্তারা মেলাতে জানিয়েছিলেন, শিশুদের মেলামুখী করা এবং তাদের সাংস্কৃতিক চর্চা ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলাই ছিল এই মেলা সূচনার মূল উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই পরবর্তী সময়ে মেলার মূল আকর্ষণ ছিল শিশুদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলায় নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ও বেচাকেনার স্টল যুক্ত হতে থাকে এবং বর্তমানে এই মেলা ঘাটাল মহকুমার গণ্ডি ছাড়িয়ে জেলার বৃহত্তর মেলাগুলির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এই জেলা ছাড়াও হুগলি, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে বহু মানুষ প্রত্যেক বছর এই মেলাতে আসেন। নানান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণও করেন বলে জানা গিয়েছে।
এই শিশু মেলার শুরুর দিকে যাঁরা শিশু হিসেবে নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন, তাঁদের অনেকেরই বয়স এখন ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে নিশ্চিন্তপুরের প্রিয়াঙ্কা মাইতি এবং কোন্নগরের অনির্বাণ দাস প্রমুখ শিশুমেলার পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করে জানান, তাঁদের সময়ে শিশু মেলা মনকে যতটা আকর্ষণ করত, এখন আর তা করে না। নাম একই থাকলেও মেলার চিন্তাভাবনার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু প্রিয়াঙ্কা বা অনির্বাণরাই নন, অধিকাংশ ঘাটালবাসীরই অভিযোগ, মেলাটি ‘শিশু মেলা’ নামে পরিচিত, বর্তমানে সেখানে শিশুদের আর কোনও গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না। শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য সে অর্থে কোনও অনুষ্ঠান নেই এবং ঘোরাফেরা বা খেলার জন্যও পর্যাপ্ত পরিসর নেই। বর্তমানে ‘শিশুমেলা’র নাম ব্যবহার করে বড়দের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ, বিষয়টি মেলা পরিচালন কমিটি উপলব্ধি করলেও শিশুদের জন্য সে অর্থে কোনও সদর্থক চিন্তাভাবনা করছেন না। তাই অনেকে আক্ষেপ ও বিদ্রুপের সঙ্গে মন্তব্য করেন, এবার মেলার নাম থেকে ‘শিশু’ শব্দটি বাদ দিয়ে দেওয়া হোক।
যদিও এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন মেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মিলন জানা। তাঁর মতে, শিশুদেরই এই মেলায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আসলে রাতের বেলায় নামী-দামি শিল্পীদের অনুষ্ঠান থাকায় বড়দের প্রচুর ভিড় হয় এবং সেটিই আমজনতার চোখে পড়ে বলে অনেকে এই ধরণের মন্তব্য করেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, দিনের বেলায় সকাল থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত শিশুদের জন্য নানা ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। রাতে শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান রাখলে অনেক অভিভাবকই সন্ধ্যার পর শিশুদের মেলায় আনতে চান না এবং যাতায়াতেরও সমস্যা হয়। বরং মিলনবাবু আক্ষেপ করে বলেন, এর আগে বহুবার শিশুদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু সেই অনুষ্ঠান দেখার মতো দর্শক থাকত না। সকলেই বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বা বহিরাগত শিল্পীদের দেখার জন্যই ভিড় করেন। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত অনুষ্ঠানের সময় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও দর্শক উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে যুগ্ম সম্পাদক প্রকারান্তরে জনসাধারণের বিনোদনপ্রীতিকেই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন।
কেয়া মণ্ডল চৌধুরী
আমার কলম ঘাটাল মহকুমার জীবনবোধের শরিক। আমি সামাজিক সমস্যার নিভৃত কান্না, অভাবের নীরব দীর্ঘশ্বাস এবং সাধারণ মানুষের গভীর অভিযোগের সুর শুনতে ভালোবাসি। আমার লেখনি আলো-আঁধারের গাঢ় পটভূমি এড়িয়ে চলে। খুন-খারাপি, রাজনৈতিক জটিলতা বা তীব্র দুর্ঘটনার মর্মান্তিক দৃশ্য আমার উপজীব্য নয়। আমি ডুব দিই লোকায়ত জীবনের সরল জটিলতায়—ঘাটালের ধূলিকণা ও মানুষের আশা-হতাশা—এরাই আমার লেখনির প্রাণ। যা আমি ‘স্থানীয় সংবাদ’-এর মাধ্যমে তুলে ধরি।