হরিরামপুর শীতলানন্দ শিবমন্দির —উমাশংকর নিয়োগী
♦পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার হরিরামপুরে অবস্থিত পশ্চিমমুখী আটচালা টেরেকোটা সমৃদ্ধ শীতলানন্দশিব মন্দিরটি দাসপুর ইতিহাসের একটি গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান। মন্দিরের সামনের মেঝেতে সিমেন্টের উপরে লেখা ‘সংস্কার ১৩৪২ সন’ থেকে বোঝা যায় মন্দিরটি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে সংস্কার করা হয়েছিল । মন্দিরে লাগানো একটি শ্বেতপাথরের ফলককে ‘পরিচারক পক্ষে শ্রী অবিনাশচন্দ্র মণ্ডল শ্রী প্রবোধচন্দ্র মণ্ডল’ লেখা আছে। সম্ভবত এঁদের নেতৃত্বে মন্দিরটির সংস্কার হয়েছিল । বর্তমানে এই দেবোত্তর সম্পত্তির মালিক বিশ্বনাথ মণ্ডল জানালেন তাঁরা দৌহিত্র সূত্রে এই মালিকানা অর্জন করেছেন। এটি হরিরাম পুরের আদকদের সম্পত্তি ছিল। কমলাকান্ত আদকের পূর্ব পুরুষ দ্বারা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। রেশম ব্যবসায় প্রভূত বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন আদকরা । সংস্কার কালে অবিনাশচন্দ্র ও প্রবোধচন্দ্র গুরুত্ব পেয়েছিলেন দেবোত্তরের মালিক ও দৌহিত্র বংশের মানুষ হিসেবে। অনুমান করা যেতে পারে দেবালয়টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর পরে সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। তাহলে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ধারেপাশে হতে পারে।
মন্দিরটির সংস্কারের সময় সামনের এবং উত্তর দেয়ালের বেশকিছু টেরেকোটা ফলক ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। মন্দিরে কাল জ্ঞাপক ফলকটি সাধারণত যেখানে থাকে সেখানটি একটি অশ্বত্থ গাছের শেকড়ে সম্পুর্ণ গ্রাস করে নিয়েছে।
দেবগৃহে প্রবেশের খিলান যুক্ত তিনটি দরজা । মূল মন্দিরে প্রবেশের পশ্চিম দিকে একটি আর দক্ষিণ দিকে একটি মোট দুটি দরজা আছে। পূর্ব দিকের খিলানে আছে রামরাবণের যুদ্ধ, রামের সঙ্গে লক্ষ্মণ এবং হনুমান। দশ মুণ্ড কুড়ি হাত রাবণের হাতে ধরা তরবারি। সূর্পনখার নাককাটা সীতা হরণ জটায়ুর সঙ্গে যুদ্ধ একেবারে উপরে হরধনুতে ছিলা পরাতে উদ্যত রামের ফলক আছে। দাসপুরের কোন মন্দিরে হরধনুতে ছিলা পরানোর ফলক নেই। মূল প্রবেশ দ্বারে কৃষ্ণের কালীয়নাগ দমন কৃষ্ণের মথুরা গমন, দানী কৃষ্ণ নৌকাবিলাস মাঝে দেশীয় রাজা পাখা হাতে দাসীবৃন্দ কৃপাণ হাতে এক দেহরক্ষী । এর উপরের ফলকে রামসীতা সিংহাসনে বসে আছেন । অন্য তিন ভাই উপস্থিত আছেন আছে পদতলে রামভক্ত হনুমান। একেবারে উপরে অনন্ত শয্যায় বিষ্ণু পদ সেবারত লক্ষ্মীদেবী থাকলেও নাভি কমলে ব্রহ্মা নেই। উত্তর দিকের প্রবেশ দ্বারের ফলকের একবারে নীচে গাছের তলায় বসে থাকা এক ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হয়েছে এক ইংরেজ রাজপুরুষ সঙ্গে দুই দেশীয় সহচর নিয়ে। তার পাশে দশভুজা দুর্গা আছে , কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী নেই আছে জয়া বিজয়া । দাসপুরে গোবিন্দনগরের গোস্বামীদের মন্দির ছাড়া আর কোন মন্দিরে দেবী দুর্গার সঙ্গে জয়া বিজয়া দেখতে পাওয়া যায় না। এর উপর ডান দিকে ও বাম দিকে প্রমোদ তরী। একটিতে সাহেব মেম , অন্যটিতে ধনপতি ? গানের আসর বসেছে , এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ তামাক খাচ্ছেন গড়গড়াতে । এই দুই তরীর মাঝে কমলেকামিনী পদ্ম ফুলের উপর বসে আছেন হাতে পদ্ম কোলে গণেশ । এর উপরের প্যানেলে সিংহাসনে বসে আছেন হরপার্বতী, শিবের কোলে গণেশ ।এই ফলকটিও বিরল। শিবের কোলে গণেশ এমন ফলক আর কোথাও আছে কিনা জানি না। অন্তত দাসপুরে নেই। মহাদেবের পাশে দাঁড়িয়ে গোমুণ্ড যুক্ত মানুষের হাত পা ওয়ালা নন্দী। এটিও দাসপুরের অন্য কোন মন্দিরে চোখে পড়েনি। এর উপরের প্যানেলে বসেছে নৃত্যগীতের আসর। তানপুরা হাতে গায়ক ও নৃত্যরতা কয়েকজন মহিলা।
মন্দিরের উত্তর দেয়ালে দরজার এক পাল্লা খুলে দাঁড়িয়ে আছে এক পুজারিনী , কাঁধে ভার নিয়ে এক ভারী । এই দেয়ালটিতে আরো অনেক টেরেকোটার ফলক ছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে সংস্কারের সময় সেগুলি ধ্বংস করা হয়েছে। চামর হাতে সাতসট্টি দেবদাসীর দেখা মিলবে এই মন্দিরে। দক্ষিণ দেয়ালে একটি মিথুন মুর্তির দেখতে পাবেন । দক্ষিণ দিকের দরজার উপরে ক্ষত চিহ্ন দেখে মনে হয় এখানেও টেরেকোটা ফলক ছিল । দেবদাসীদের উপরে ষোলটি শিবলিঙ্গ সহ শিব মন্দির আছে। শিব মন্দির উপরেও টেরেকোটা ফলক আছে সেইগুলি গাছের শিকড়ের আর পাতার আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছে। জানিনা কী রহস্য লুকিয়ে আছে এই ফলকগুলির মধ্যে। মন্দিরের সম্মুখ ভাগের দক্ষিণ ও উত্তর দেয়ালে দশাবতারের ফলক আছে । এখানেও এক অবতার জগন্নাথ । দশম অবতার কে ছিলেন এই মন্দিরে আজ তা জানার উপায় নেই । গাছের শেকড়ে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে ফলকটি । মন্দিরটির আশু সংরক্ষণ প্রয়োজন। এখন শীতলানন্দ শিব গ্রামের। এখনো সমারোহে গাজন হয়। হরিরামপুর সহ আশপাশের গ্রামে বিত্তশালী মানুষের অভাব নেই। অভাব উদ্যোগের । উদ্যোগ নিলে মন্দিরের উপরে গজিয়ে ওঠা গাছগুলি কেটে পরিষ্কার করে আরো কিছুদিন গ্রামের গর্ব মন্দিরটিকে বাঁচিয়ে রাখা খুব কঠিন কাজ হবে না বলে আমার বিশ্বাস।