কাজলকান্তি কর্মকার [প্রতিবেদকের সম্বন্ধে জানতে 👆এখানে ক্লিক করুন]: এখন সামাজিক মাধ্যম খুললেই দেখা যাচ্ছে রাজ্যের সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে নানা রকম ট্রোল ও বিদ্রুপ চলছে। ট্রোলের সূচনা হয়েছে, বাঁকুড়া জেলায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের স্কুলে পড়ানোর ইস্যু নিয়ে। ওই জেলায় পুলিশ ও প্রশাসন নির্দেশ দিয়েছিল, সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে প্রাথমিক স্কুলে পড়ানো হবে। যদিও পরে ওই নির্দেশ বাতিল হয়ে যায়। পরে আদালত রায় দেয়, সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে কোনও প্রশাসনিক [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]কাজ করানো যাবে না। কোন দপ্তরের কর্মীদের দিয়ে কী কাজ করানো যাবে, কী করানো যাবে না সেটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিষয়। বিতর্ক উঠলে সেটা আদালতের বিচার্য বিষয়। তা নিয়ে কিছু বলার নেই।
আমার প্রশ্ন, এই ইস্যু নিয়ে সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিদ্রুপ করার পেছনে কী যুক্তি রয়েছে? এমন তো নয়, সিভিক ভলান্টিয়াররা নিজে থেকে স্কুলে পড়ানোর দাবি তুলেছিলেন। সেক্ষেত্রে বিদ্রুপ করার যুক্তিটা জোর করেই মেনে নেওয়া যেতে পারত।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিটি এলাকার সঙ্গে থানার নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করার জন্য কম মাইনের এই সিভিকদের নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি গ্রামে এবং ওয়ার্ডে একজন করে এই সিভিক নিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় সিভিকদের যে ভাবে অপমান করা হচ্ছে এর আগে অন্য কোনও পেশার মানুষকে এতো সরাসরি অপমান করার ঘটনা কখনও দেখা যায়নি। মনে হয়, সিভিক মানেই সমাজ-শত্রু, বিশেষ প্রজাতির সমাজ বিরোধী। আমি মানছি, কিছু কিছু সিভিক ভলান্টিয়ারের আচার-আচরণ সে অর্থে মার্জিত নয়। মনে রাখবেন, তার জন্য সমস্ত সিভিক ভলান্টিররা দায়ী নন। যিনি খারাপ ব্যবহার করেন তিনি মানুষ হিসেবেই সম্পূর্ণ নন। তিনি আজ সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ করছেন কিন্তু তিনি যদি অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হতেন তাহলেও তিনি সেখানে ওই ধরনের ব্যবহারই করতেন। আপনারা কি কখনও কোনও আধিকারিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক বা ব্যবসায়ীকে তাদের কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত রুঢ় বা বাজে ব্যবহার করতে দেখেননি?
সিভিক ভলান্টিয়াররা ডিউটির ক্ষেত্রে এমন আচরণ করেন সেটা অনেকের পছন্দ হয় না। তাই অনেকেই সিভিকদের প্রতি রুষ্ট। তার আগে মনে রাখতে হবে, সিভিকরা ডিউটির সময় যা করেন সবই কিন্তু সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, এসআই বা এএসআইয়ের নির্দেশে। সিভিকদের নিজেদের ইচ্ছেয় কোনও কাজ করার ক্ষমতা নেই। কারণ সিভিকরা বাড়াবাড়ি করলেই থানা থেকে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ফোনে টাইট দিয়ে দেওয়া হয়। তাই রাস্তায় গাড়ি ধরার সময়ই হোক, বা আপনার এলাকায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের ডিউটি করার সময়ই হোক তারা যে আচরণটি করেন সেটি মূলত থানার নির্দেশেই হয়ে থাকে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন মন্তব্য দেখে আমার যা মনে হয়েছে, সিভিক ভলান্টিয়াররা যেহেতু পাড়ার ছেলে এবং খুব কম বেতনের চাকরি করেন সেজন্য অনেকেই চান সাধারণ মানুষকে দেখলে সিভিক ভলান্টিয়াররা যেন স্যালুট করে বা অন্য ভাবে মাথা নিচু করে সম্মান করেন। সিভিক ভলান্টিয়ারদের স্বতন্ত্র চলাফেরাটা অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হয়ে গিয়েছে। ব্যক্তিগত রাগ থেকেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের ট্রোল করা হয়ে থাকে।
আর সিভিক মানেই যে খুব স্বল্প শিক্ষিত সেটা মনে করার কোনও কারণ নেই। যারা তাঁদেরকে নানা ভাবে বিদ্রুপ করেন তাঁদের অনেকের থেকেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের পড়াশোনাটা েবশি। অনেক সিভিক ভলান্টিয়ারকে আমি জানি যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স গ্রাজুয়েট বা মাস্টার্স। অন্য চাকরির সুযোগ নেই। তারা কাউকে প্রতারণা না করে, চিট ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে নিজের ও পরিবারের পেট চালানোর জন্য ওই কাজ করছেন। তাই তাদের ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যা কাজ করতে বলে সেটাই করতে হবে। বাঁকুড়া জেলা থেকে স্কুলে পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আগামী দিনে সিভিক ভলান্টিয়ারদের যদি নির্দেশ দেওয়া হয় বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠোনে ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে, সেটাই তাঁদের মেনে নিতে হবে। কারণ, পেট চালানোর দায় রয়েছে। প্রতিবাদ করার কোনও প্লাটফর্ম নেই। তাই তাদের হাজারো বিবেকের দংশন থাকা সত্ত্বেও সিভিকদের সব কিছু মেনে নিতে হচ্ছে।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, যেহেতু সিভিকদের বেতন খুবই কম তাই এক এক জন সিভিকের সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কিম্বা পাঁচ-ছ’ কিলোমিটারের মধ্যে ডিউটি পড়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কোনও সিভিকের আচরণ পছন্দ না হলে কিম্বা কোনও সাব-ইন্সপেক্টরের কোনও সিভিককে ব্যক্তিগতভাবে ‘না-পসন্দ’ হলে তাঁকে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে গঞ্জ পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাইকের তেল পুড়িয়ে যেতে হয় নিজেদেরই। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে এক টানা ১৬-১৮ ঘণ্টা করেও ডিউটি করানো হয় বলে অভিযোগ। ওই ভাবে সিভিক ভলান্টিয়ারদের অমানবিক পরিশ্রম করানো হলেও তাদেরকে কখনও ‘অতিরিক্ত অর্থ’ দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ ইচ্ছে করলেই, রাস্তায় গাড়ি ধরা সহ অন্যান্য কাজ করালে সিভিকদের কিছু টাকা দিতেই পারে। তা কিন্তু দেয় না। এর ফলে সিভিকদের ক্ষোভ বাড়ছে। তবু কিছু করার নেই। ২০২২ সালে ১২ সেপ্টেম্বর চন্দ্রকোণা থানার মল্লেশ্বরপুরের বাসিন্দা এক সিভিক ভলান্টিয়ার রাজকুমার মণ্ডলের (৩২) দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর সেই ক্ষোভ আরও বেড়ে চলেছে। সিভিকদের অভিযোগ, চন্দ্রকোণা থানার কয়েকজন সাব ইন্সপেক্টরের খামখেয়ালিপনার জন্যই ওই সিভিক ভলান্টিয়ারের অকাল মৃত্যু হয়েছে। ওই রাতে রাজকুমারবাবুকে জোর করে বাড়ি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ডিউটিতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে রাতে রাস্তায় নামিয়ে গাড়ি থামানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানেই তাঁকে লরি পিষে দিলে তাঁর মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার পর সিভিকরা আরও মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছেন। কোনও উপায় নেই বলেই তাঁরা ওই কাজটা ছাড়তে পারছেন না। সেই সঙ্গে তাঁরা কোনও রকম প্রতিবাদও করতে পারছেন না। প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই বলে সিভিকদের সে অর্থে কোনও সংগঠনও নেই। কোনও সংগঠন করে যদি প্রতিবাদ করতে শুরু করেন তাহলে সেই খবর সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছে সিভিকদের উপর আরও শাস্তি বেড়ে যাবে। তাই সমস্ত কিছুই মুখ বুজে সহ্য করতে হয় তাদের।
এবিষয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, সিভিকদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় থানা স্তর থেকে। তাই তাদেরকে কী ধরনের ডিউটি দেওয়া হয় সেটা সব ক্ষেত্রে আমাদের জানার কথা নয়। তবে মানসিক অত্যাচার করে কাউকে ডিউটি দেওয়া ঠিক নয়। এনিয়ে যদি কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের জানানো হয় আমরা তাহলে সেই থানার সঙ্গে কথা বলতে পারি। •প্রতিবেদক রাজ্যস্তরের একটি দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক মো: 9933066200।