জানেন কি, নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন পরিষেবার জন্য চাই সেচ্ছা রক্তদাতা?
[মেদিনীপুর ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে লেখাটি প্রাপ্ত]
আমরা বোধহয় রক্তদান বিষয়টি সকলেই জানি, তবে বুঝি না। প্রতিটি সংগঠন তাদের বাৎসরিক কর্মসূচিতে ধিরে ধিরে রক্তদান শিবিরের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন রাখছেন। কিন্তু এতকাল পরেও প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র পাঁচ জন বোকা মানুষই রক্তদানের বিষয়টিকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করেন। অনেকেই বলবেন যারা রক্তদান করেন তারা বোকা হতে যাবেন কেন? না, আসলে তা নয়। আমরা বাকি নয়শো পঁচানব্বই জন মানুষের এই চালাকি দেখে হতবাক হয়ে একথা বলছি। কারণ, তারা যখনই আত্মীয় সজনের জন্যে রক্তের দরকারে পড়েন, তখন ঐ সমাজ সচেতন মানুষগুলোর পিঠে চড়ে বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে হবে এই চালাকিটা জানেন। এই ভাবে আর কতদিন চলবে?
•জানেন কিভাবে রক্তদান বিষয়টি শুরু হল?
—আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে ইংলন্ডের বিজ্ঞানী ডাঃ উইলিয়াম হার্ভে মানুষকে জানিয়েছিলেন রক্ত মানুষের শরীরে নদীর স্রোতের মতই চলমান। সারাদিনে হৃৎপিন্ড একলক্ষ বারের কিছু বেশি বার পাম্প করতে পারে। আর তার ফলে একটি রক্তকণাকে শরীরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে প্রায় কুড়ি হাজার মাইল পরিক্রমা করতে সাহায্য করে। সে আপনি জেগেই থাকুন আর ঘুমিয়ে থাকুন। কি অবাক হচ্ছেন! কিন্তু এর চেয়েও অবাক করা বিষয়, ১৮১৮ সালের আগে মানুষ জানতই না যে একজন মানুষের রক্ত দিয়ে অন্য আর একজন মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। সেবছরে ইংলন্ডের আর এক মহান ডাক্তার জেমস্ ব্ল্যান্ডেল এক প্রসূতি মাকে তাঁর তৈরি করা এক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রসূতির স্বামীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে রক্ত সঞ্চালন করে নিশ্চিৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলেন। এভাবেই রক্ত সঞ্চারণ পদ্ধতিটি আবিস্কার করে ফেলেন। দিনটি ছিল ২২ শে ডিসেম্বর ১৮১৮। এরপর ঐ ডাক্তার বাবু এমন আরও দশটি রক্ত সঞ্চালন করেছিলেন, কিন্তু সফলতা এসেছিল মাত্র পাঁচটি ক্ষেত্রে। এভাবে আরও একশত বছর গড়িয়ে গেল। একদিন কিছু ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে আর এক চিরস্মরণীয় ব্যাক্তি ডাঃ কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার আবিষ্কার করে ফেললেন রক্তের গ্রুপ। সালটা ১৯০১। ব্যস! তার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে। আজকাল, প্রতি তিন মিনিটে একজন মানুষের রক্তের প্রয়োজন হয়। ধিরে ধিরে গত এক শতকে রক্ত সংরক্ষণের জন্য তৈরি হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্লাড ব্যাঙ্ক, অত্যাধুনিক ট্রান্সফিউশান সেট, পলি ভিনাইল ক্লোরাইড দিয়ে তৈরি ব্লাড ব্যাগ। কিন্তু একটা জিনিস যেটা আজও বদলায়নি সেটা হল মানুষের জন্য মানুষকেই রক্তদান করতে হবে। আজও কলকারখানায় কিংবা কোনো ল্যাবোরেটারিতে রক্ত তৈরি করা সম্ভব হয় নি।
•রক্তদান সহজ হলেও, রক্ত নেওয়া মোটেই সহজ নয় জানেন কি?
এক মানুষের শরীরের রক্ত অন্য মানুষের শরীরে সঞ্চারণ করার কাজটি মোটেই সহজ নয়, এমনকি একশো ভাগ নিরাপদও নয়। রক্তের মাধ্যেম একজনের ভাইরাস কিংবা জীবানু ঘটিত কোনো রোগ গ্রহীতার শরীরে অনায়াসের ঢুকে যেতে পারে। তাই ব্লাড ব্যাঙ্কে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিরীক্ষা বা টেষ্ট করার পরই সেই রক্ত রোগীকে সঞ্চারণের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। পরীক্ষাগুলি হল, এইচ আই ভি (এইডস রোগ নির্ণায়ক), হেপাটাইটিস-বি ও সি, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়া। এরপর পরীক্ষা হয় রক্তের গ্রুপ ও রেসাস ফ্যাক্টর। শুধু তাই নয়, রোগীর রক্তের যখন দরকার হয় তখন রোগীর রক্তের সঙ্গে রক্তদাতার রক্ত মিলিয়ে দেখা হয়, কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা। এই পরীক্ষাটির নাম কমপ্যাটিবিলিটি টেষ্ট বা ক্রসম্যাচ পরীক্ষা।
•এত পরীক্ষা হলেও রক্ত সঞ্চারন নিরাপদ নয় কেন?
আসলে এর জন্য জানতে হবে উইন্ডো পিরিয়ড সম্পর্কে। কারও শরীরে রক্তবাহিত রোগের ভাইরাস প্রবেশের পরে বেশ কিছুমাস তা যন্ত্রের মাধ্যমে ধরাই যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না শরীরে যথেষ্ট মাত্রা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, ততক্ষণ যতই উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করুন, তা ধরা পড়বে না। এমন অবস্থায় কেউ রক্তদান করলে, রক্তগ্রহীত রুগী কিন্তু ঐ রক্তদাতার চেয়ে দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
•তাহলে উপায় কি?
উপায় হল একটাই। স্বেচ্ছা রক্তদান। আসলে স্বেচ্ছায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো ব্যাক্তি ভয় কিংবা লোভের বসবর্তী না হয়ে রক্তদানে এগিয়ে এলে তিনি মানুষের কখনই ক্ষতি করবেন না। ডাক্তারবাবুর কাছে রক্তদান শিবিরে সবটাই খুলে বলবেন- যেমন জ্বর হয়েছিল কিনা, কোনো ঔষধ খান কিনা, বাজে কোনো অভ্যাস আছে কিনা এমনকি রক্ত দান করার তিন মাসের মধ্যেই আবার রক্ত দিচ্ছেন কিনা।
এবার ভাবুন, কোনো আত্মীয় যদি ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত না থাকার কারণে গিয়ে রক্ত দেন, তিনি কিন্তু এমন সততা নাও দেখাতে পারেন। দেখা গেল ঐ রক্তদাতা রোগীর কাছে কৃতজ্ঞ কিংবা অফিসের বসের কোনো লোক কিংবা অমুখ দাদা বলে দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই ঐ আত্মীয় বন্ধু রক্তদাতা গোপন করবেন তার সমস্যা বা রোগের কথা । এতে রোগী সাময়িক সুস্থ হলেন হয়তোও, তারপর দেখা গেল হেপাটাইটিস বা এইডস্ আক্রান্ত। এমনও হতে পারে, আত্মীয় সেজে এমন কোনো মানুষ টাকার জন্য রক্তদান করতে ব্লাড ব্যাঙ্কে পৌছালো, এবং রক্তদান করে রোগীকে আর এক রোগ উপহার দিল। তাই রক্তদান শিবিরে স্বেচ্ছা রক্তদাতাই নিরাপদ রক্তদাতা।
•রক্তদান শিবিরে তাই কোনো দামী উপহার দেওয়ার প্রথাও ত্যাগ করুন?
আচ্ছা বলুন তো, রক্তদান শিবিরে আপনারা রক্তদাতাকে যে আর্থিক মূল্যের উপহার দেন যেমন, ছাতা, বিছানার চাদর, প্রেসার কুকার, ঘড়ি ইত্যাদি – এগুলো কি রক্তদাতাদের বাড়িতে নেই? আসলে দাতা রক্তদানের বিনিময় শুধুই চান ভালোবাসা, স্বীকৃতি, সম্মান এবং সারাবছর ধরে যোগাযোগ। কিন্তু এর কোনোটাই আমরা করি না। শিবিরের দিন মুখ্য অতিথিকে নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি, দাতার সঙ্গে দেখাও করিনা গুরুত্ব দেওয়া তো দুরের কথা। উল্টে যে ছেলেটা প্রতিবছর ক্লাবে রক্তদান করে, তাকে কোনদিন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ডেকে আপ্যায়ণও করিনা। রক্তদান শিবিরে টাকার মূল্যে উপহার দিলে রক্তদাতার সংখ্যা বাড়বে এই ধারণা আসলে ভূল। বরং লোভী মানুষ নিজেদের সব রোগের বিষয় গোপণ করে রক্তদান করে পেতে চাইবেন ঐ টাকার উপহার, ফলে দাতা ও গ্রহীতার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
•রোগীর প্রয়োজনে ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে কিভাবে মিলবে রক্ত?
রক্তের প্রয়োজন হলে বাজারে কিংবা হাটে গেলে মেলে না। যেতে হবে ব্লাড ব্যাঙ্কে। প্রথমেই ডাক্তার বাবু একটি চাহিদা পত্র বা রিকুইজিশান দেবেন, সঙ্গে দেবেন দুই ভায়াল রুগীর রক্তের নমুনা। এগুলি নিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্কে গেলে তবেই রক্ত মিলবে। গ্রুপ ও ক্রুশম্যাচ পরীক্ষার পর একটি কাগজে তার বিবরণ লিখে রক্তের ইউনিট বা ব্যাগ আপনাকে দেওয়া হবে ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে। মনে রাখবেন, ঐ ক্রুশম্যাচ কাগজ বা স্লিপটি সঙ্গে না আনলে হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে রক্ত চালাবেন না ডাক্তারবাবু। তবে নার্সিং হোমে ভর্তি থাকলে রোগীর জন্য রক্ত আনতে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে গেলে ১১০০ টাকা লাগবে। এজন্য রক্তদান করলে আপনি পাবেন একটি ক্রেডিট কার্ড, যার বিনিময়ে আগামী একবছরে আপনি এক ইউনিট রক্ত পেতে পারেন বিনামূল্যে। শর্ত, যদি রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে মজুদ থাকে। তবে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকলে কিন্তু ক্রেডিড কার্ডের কোন প্রয়োজন নেই।,
•অনেকে বলেন, এত রক্তদান হচ্ছে কাজে কি লাগে?
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রক্তের প্রয়োজন হয় অনেকগুলি চিকিৎসায়। বড় দুর্ঘটনায়, প্রসূতি মায়ের সন্তান প্রসব কালে, নবজাত শিশুর অতিমাত্রায় জন্ডিস থাকলে, ক্যান্সার, ডায়ালিসিস বা কিডনির রোগ, বড় অপারেশন, শরীরে অতিমাত্রায় হিমোগ্লোবিন ৭ গ্রাম/ডেসিঃলিঃ এর কম বা অ্যানিমিয়া থাকলে, পুড়ে যাওয়া রোগী, মশা বাহিত ডেঙ্গু হলে দরকার হয় রক্ত সঞ্চারণের। এছাড়াও রক্তের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় জিনগত রক্ত জনিত বিকলাঙ্গতা অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া, সিকেল সেল অ্যানিমিয়া ও হিমোফিলিয়া আক্রান্তদের চিকিৎসা ও বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। বলা যায় প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে অন্ততঃ ২০ জন রক্তদাতা থাকলে রক্তের কোন অভাবই হবে না। সেখানে রক্তদাতার সংখ্যা মাত্র ৫-৬ জন। তাই গরম পড়লেই, ভোট এলে কিংবা যেকোনো উৎসবের সময় রক্ত না থাকার কারণে সমস্যায় আপনিও পড়তে পারেন। এজন্য রক্তদান শিবির করা চাই প্রতিদিন। কোন বিখ্যাত দিবসের দিনে নয়।
•রক্ত দান করলে রক্তদাতার কী লাভ?
পুরুষেরা বছরে চারবার ও মহিলারা বছরে তিনবার রক্ত দিতে পারেন। রক্তদান করলে হৃদরোগ, রক্তচাপ, ক্যান্সার এসব হওয়ার সম্ভাবণা কমে। শরীরে বেড়ে ওঠে রক্ত তৈরি হওয়ার ক্ষমতা। এছাড়া পাঁচটি রোগের পরীক্ষা আবশ্যিক ভাবেই ব্লাড ব্যাঙ্কে হয়। তাই প্রতিনিয়ত রক্তদিলে এই টেষ্টগুলিও বিনামূল্যে হবে। সোজা কথায় রক্ত দিলে শরীর আরও সুন্দর ও সুস্থ থাকবে।
•আমি কী রক্ত দিতে পারব?
বয়স যদি ১৮ থেকে ৬০ এর মধ্যে হয়, শরীরের ওজন যদি ৪৫ কেজির উর্ধ্বে থাকে, সম্প্রতি বড় কোনো অসুখ হয় নি, স্বাভাবিক জীবন-যাপণ করেন- তবে পুরুষেরা বছরে সর্বাধিক চারবার ও মহিলা বছরে তিনবার রক্তদান করতে পারেন, যদি শিবিরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর রক্তদানের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। তাই আমরা বলি, বছরে একবার রক্তদান করে বোকা হতেই পারেন। শিবিরে স্বেচ্ছা রক্তদাতা নিরাপদ রক্তসঞ্চালণ পরিষেবার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কারণ সোস্যাল মাধ্যমে রক্তের আবেদন করে রক্ত মেলে না! চাই শিবিরের স্বেচ্ছারক্তদাতা।
রক্তদান জীবন দান, রক্তদান মহৎ দান।