সুপ্রাচীন দারুমূর্তি বিশালাক্ষী ও দিগম্বর জৈনের পুজো একই মন্দিরে
—উমাশংকর নিয়োগী
•আসুন আজ আমরা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার চাঁইপাট গ্রামের ভবানী গোস্বামী পরিবারের বিশালাক্ষীর সুপ্রাচীন পরিত্যক্ত দারুমূর্তি ও বর্তমানে পূজিত পাষাণে খোদিত মূর্তি দর্শন করব । ঘাটাল পাঁশকুড়া বাস রাস্তা ধরে সুলতাননগর মোড়ে নামুন , এখান থেকে বাস বা ট্রেকার যাচ্ছে গোপীগঞ্জ । সুলতাননগর থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে চাঁইপাট গ্রাম । চাঁইপাট দাসপুর থানার সব থেকে বড় গ্রামের নাম । এই গ্রামের বাজারে নামুন । সামনেই একটি শিবমন্দির আছে। এখান থেকে বাঁ দিকে একশো মিটারের মধ্যেই মন্দিরটির অবস্থান। যাকে হোক বলুন বাদুড়বাগান যাব। দেখিয়ে দেবে। এখানে শদুই বছরের একটি বট গাছে হাজার খানেক বাদুড় দেখতে পাবেন । সুদূর অতীত কাল থেকে এখানে ওরা ঘর সংসার পেতেছে । বট গাছটি একটি প্রাচীন শিবালয়কে জড়িয়ে উঠেছে। শিবালয়টি পশ্চিমমুখী ছিল কিনা আজ আর বোঝার উপায় নেই। এর সামনেই একটি পশ্চিমমুখী সপ্তরথ শিব দেউল আছে, এর ভেতরে গোটা পাঁচেক শিবলিঙ্গ আছে। আরো বেশকিছু ভগ্নস্তুপ আছে যেগুলি দেখলেই বোঝা যায় এগুলোও মন্দির ছিল। শরৎ গোস্বামীর পুত্রবধূ ছবি গোস্বামী জানালেন এগুলি সবই সাধকদের সামাধির উপর নির্মিত শিব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ।
ভবানীপ্রসাদ গোস্বামী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানালেন পূর্ব পুরুষের মুখে শুনেছেন বর্ধমান রাজার বদান্যতায় বিশালাক্ষীর পুরোনো দক্ষিণমুখী মন্দিরটি ৯১১ বঙ্গাব্দে , ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভবানীপ্রসাদ গোস্বামীর দেওয়া তথ্য সঠিক হলে আমরা জানি বরদার জমিদার শোভাসিংহ ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করেছেন এবং তিনি বরদার বিশালাক্ষী দেবীর প্রতিষ্ঠাতা । তাহলে তার প্রায় একশো বছর আগে বিশালাক্ষীর পুজো এতদ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। দেবীর সেবা চালানোর জন্য বর্ধমান রাজা ৯০০ একর জমি দান করেছিলেন। এটি একটি মঠ। এই মঠের মঠাধীস মহন্ত নামে পরিচিত। যত দূর জানা যায় প্রথম মহন্ত ছিলেন কপিলনারায়ণ দেব ভারতী । প্রভাতচন্দ্র দেব ভারতীর পর শেষ মহন্ত ছিলেন শঙ্করীপ্রসাদ দেব ভারতী। চাঁইপাটের এই মঠ তারকেশ্বরের মহন্তদের গুরুমঠ । বহু চিঠি তারকেশ্বর থেকে গুরুমঠে এসেছে। কিছুদিন পূর্বেও তাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন । পূর্বে নাগা সন্ন্যাসীরা গঙ্গাসাগরে স্নান করতে যাওয়ার পথে এই মন্দিরের কাছে রাত্রি যাপন করতেন । গোস্বামী পরিবার তাঁদের আটা ঘি ইত্যাদি দিয়ে ভাণ্ডারার ব্যবস্থা করতেন । মন্দিরের পাশেই একটি মন্দিরে কপিল মুনির কষ্টি পাথরের মূর্তি ছিল। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে মূর্তিটি চুরি হয়ে গিয়েছে। চাঁইপাট ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট শরৎচন্দ্র গোস্বামী পর্যন্ত দেবীর প্রায় সমস্ত কিছু বজায় ছিল । দেবীর নিত্য দুসের চালের নিরামিষ ভোগ হত । পরবর্তীকালে দেবীর নামে থাকা প্রায় সমূহ জমি ভেস্ট ও বর্গা হওয়ার ফলে বর্তমানে আর্থিক অবস্থার ক্রমাবনতি হয়েছে। নিত্য ভোগ বন্ধ । এখন বিশেষ বিশেষ দিনে ভোগ নিবেদন করা হয়। অন্য দিনে নৈবেদ্য দিয়ে পুজো হয়। হাই কোর্টের মহামান্য বিচারপতি, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি দেবীর দর্শন করে গিয়েছেন।
যাক ওসব কথা এবার চলুন, একটু এগিয়ে যাওয়া যাক পূর্ব দিকে। ঐ যে বিশালাক্ষীর পশ্চিমমুখী চাঁদনি মন্দির দেখা যাচ্ছে। আমরা এখন মায়ের মন্দির চত্বরে এসে পড়েছি। ডান দিকে যে কুটীর দেখছেন এটি এক বিখ্যাত যোগী বাকসিদ্ধ পুরুষ শঙ্করীপ্রসাদ দেব ভারতীর সাধন ভূমি। এই কুটীরেই বহু মহন্ত তাঁদের সাধন জীবন কাটিয়ে পরলোক গমন করেছেন। শঙ্করীপ্রসাদ সম্পর্কে জনমানসে বহু অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত আছে। এখন আমরা একেবারে মন্দিরের সামনে উপস্থিত হয়েছি। একটি প্রস্তর ফলকে লেখা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ মন্দিরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মহামান্য প্রধান বিচারপতি শ্রী শংকরপ্রসাদ মিত্র । ঐ বছরেই বিশালাক্ষীর ভগ্নপ্রায় দারুমূর্তির পরিবর্তে পাষাণে খোদিত মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। জয়পুর থেকে শ্বেতপাথর আনিয়ে কুমোরটুলির ভাস্কর দিয়ে মূর্তিগুলি খোদাই করা হয়েছে।
প্রথমেই আমরা দেবী দর্শন করব। সিংহ স্কন্ধারূঢ়া দেবীর এক পা সিংহে অন্য পা মহিষাসুরের কাঁধে । ইনি চতুর্ভুজা। এক হাতে খড়্গ অন্য হাতে ঢাল । আর এক হাতে বাণ অন্য হাতে সাপের লেজ ও মহিষাসুরের চুল ধরে আছেন। দেবীর ডান এবং বাম দিকে আছেন লক্ষ্মী গণেশ ও সরস্বতী কার্তিক। দেবী মূর্তির বাম দিকের কোণে অযত্নে পোড়ে আছে প্রাচীন দারু মূর্তিগুলি।দারু মূর্তিতে পুজোর সময় জল দিয়ে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে । অন্তত দুশো বছরের বেশি পুরোনো দারুশিল্পের অনন্য নিদর্শন এ গুলি । আজ থেকে অন্তত দুশো বছর আগের ওড়িশার কোন এক অজ্ঞাত দারুশিল্পী দ্বিভুজা বিশালাক্ষীর বস্ত্র অলংকার সমস্তই অসামান্য দক্ষতায় বেল কাঠের উপর খোদাই করে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেবীর মূর্তিটি দেখার মত। আপনা থেকে মাথা নত হয়ে যায়। আছে গণেশ ,কার্তিক , লক্ষ্মী ও সরস্বতী । মহিষাসুর, সিংহ ছাড়াও মুরলীধর কৃষ্ণ অগস্ত মুনি বিন্ধ্যাচলের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কাদিলপুর ছাড়া আর কোথাও দাসপুরে অগস্ত মুনি পুজো হয়না বলে আমাদের ধারণা ছিল সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে এই মন্দিরে এসে । আছে পঞ্চমুণ্ডিতে বসা সাধকের দারু মূর্তি । আরো কয়েকটি দারু বিগ্রহ আছে। দেবীর ডান দিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা আপনার জন্য অবাক বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে দুটি বিশেষ মূর্তি , দেখে পাথরের বলে মনে হয়েছে।
বেশ কয়েকটি শালগ্রাম শিলা , কাঠের জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা , চন্দন চর্চিত গুরুর খড়ম । এখানেই আছে বুকে পদ্ম নিয়ে দিগম্বর জৈন ও আরো একটি সম্ভবত জৈন মূর্তিই। এখানে নিয়মিত এঁরা পূজিত হচ্ছেন। হিন্দু ধর্মের পরমত সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল উদাহরণ এই মূর্তির পূজা । জৈন ধর্ম প্রন্থ ‘আচারাঙ্গ সূত্তে’ জৈন ধর্ম প্রচারে এসে ধর্মগুরু কীভাবে চেতুয়ার মানুষদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছিলেন তার বর্ণনা আছে। এটি দাসপুরের ধর্ম বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। মূর্তির প্রাচীনত্ব নির্ণয়ের বিদ্যাবুদ্ধি আমার নেই । যদি প্রাচীন হয় তবে দাসপুর জনপদের প্রাচীনত্ব প্রমাণে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই জৈন মূর্তিগুলি। একটি পারিবারিক মন্দির এত বৈচিত্র্য নিয়ে অপেক্ষা করছে । এই মন্দির পারিবারিক হলেও এটি আমাদের গর্বের মন্দির। মূর্তি ও মন্দিরটি আশু সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে আমদের সকলের সহযোগিতার জরুরি প্রয়োজন।
ঋণ স্বীকার: •ভবানীপ্রসাদ গোস্বামী(চাঁইপাট), ছবি গোস্বামী(চাঁইপাট), দেবাশিস চক্রবর্তী (চাঁইপাট), মণিকান্ত বেরা (সোনাখালি) এবং কমললোচন প্রধান (চাঁইপাট)।
Home এই মুহূর্তে ব্রেকিং সুপ্রাচীন দারুমূর্তি বিশালাক্ষী ও দিগম্বর জৈনের পুজো একই মন্দিরে —উমাশংকর নিয়োগী