দেবাশিস কুইল্যা
বাংলা ভাষা আন্দোলনে বরাক উপত্যকা : বাংলাকে সরকারি দপ্তরের ভাষাকরণের দাবিতে ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের তুলনায় কম ছিল না । আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যেহেতু ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী। এই গণ আন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ১৯৬১ সালের ১৯ মে ঘটে, সেদিন ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে।
১৯৬০-৬১ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনার প্রেক্ষাপট ও সম্পাদনা: ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০,০০০( পঞ্চাশ হাজার ) বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। অন্য ৯০,০০০(নব্বই হাজার) বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র আশ্রয় নেয় । ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়। সমস্ত বিরোধীতা উপেক্ষা করে ১০ অক্টোবর ১৯৬০; অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
আন্দোলনের সূচনাসম্পাদনা : বরাক উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি ” কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ ” নামে সংগঠনেরজন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল পনের দিন ব্যাপী একটি দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে শেষ হওয়া এই পদযাত্রায় অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল কাছাড় উপত্যকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১এর মধ্যে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে যদি ঘোষণা না করা হয় তাহলে তারা ১৯ মে ব্যাপক হরতাল করবেন। জোর করে আন্দোলন দমিয়ে রাখতে ১২ মে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করে ।১৮ মে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক বিধুভূষণ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে।
পূর্বসূচী অনুযায়ী ১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট সহ বিভিন্ন জায়গায় পিকেটিং শিলচরে রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
বিকেল প্রায় ২:৩০র সময় ন’জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়। গুলিতে ১২ জন আহত হন । তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; পরে দু’জন মারা যান। ২০ মে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন।এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ‘আ মরি বাংলা ভাষা, তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালবাসা”
তথ্যসূত্র :- ১) “আসামের ১১ ভাষা-শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি”। প্রথম আলো। ২) “বাঙালির চেতনায় শুধু একুশে, স্থান নেই উনিশের শহীদদের”। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় । এই সময় ; ১৯শে মে ২০১৩।