তৃপ্তি পাল কর্মকার, ‘স্থানীয় সংবাদ’ ঘাটাল: এবার ঘাটাল মহকুমায় অ্যাসিড হানা কমবে, ২২ ডিসেম্বর ঘাটাল আদালতে অ্যাসিড হানা মামলায় শাস্তি ঘোষণার পর এমনটাই অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন। ঘাটাল মহকুমায় অ্যাসিড ছোঁড়ার ঘটনা অনেক ঘটলেও যাবজ্জীবন শাস্তি পাওয়ার ঘটনা কখনও শোনা যায়নি। মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী তপনকুমার ভট্টাচার্য বলেন, ওই দিন ঘাটাল মহকুমার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সঞ্জয়কুমার শর্মার এজলাসে মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে খুনের জন্য দাসপুর থানার বড় শিমুলিয়ার বাসিন্দা দু’জনের(নন্দ সামন্ত এবং তার স্ত্রী শ্যামলী সামন্ত) যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড
ও ৫০ হাজার টাকা করে মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং অন্য দু’জনের(স্বদেশ সামন্ত এবং তার স্ত্রী নমিতা সামন্ত) পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা করে মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। অ্যাসিড মামলায় ঘাটাল মহকুমায় নজির বিহীন এই শাস্তি ঘোষণার পর থেকেই অ্যাসিড ছোঁড়া বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে চর্চা শুরু হয়েছে। অ্যাসিড ছোঁড়ার ঘটনায় দোষীরা উপযুক্ত শাস্তি পাওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন অনেকেই। ঘাটাল আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী দেবকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ৩২৬ ধারায় যাবজ্জীবন সশ্রমকারাদণ্ড বা কমপক্ষে ১০
বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশের কথা আগেও ছিল। বেশ কয়েক বছর হল ওই ধারার সঙ্গে একটি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। সেটি হল ‘৩২৬এ’। ‘৩২৬এ’ এটা বিশেষত করা হয়েছে অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে। এই ধারাতে দোষী সাব্যস্ত হলে কমপক্ষে ১০ বছর, সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং তার সঙ্গে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। সাম্প্রতিক রায়ে সেটাই দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন ভাবে জানা গিয়েছে, ঘাটাল মহকুমায় প্রায়ই অ্যাসিড হামলা হয়। খুব ছোট-খাটো ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। বিগত কয়েক বছরে
যে অ্যাসিড হানাগুলির থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল সেগুলি এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
•২০২০, ৩১ জুলাই: ঘাটাল থানার পান্না গ্রামের বাসিন্দা অনুপ পালের গায়ে তাঁরই দাদা অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে বলে ঘাটাল থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। ওই দিন ভোরে দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটির সময় অনুপবাবুর গায়ে তাঁর দাদা উত্তম পাল অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে বলে ঘটনা সূ্ত্রে জানা গিয়েছে।
•২০১৯, ৫ অক্টোবর: ঘাটাল থানার দলপতিপুরের বড়পুলের সামনে রাত ৯টা নাগাদ ভাস্কর রায় নামে এক ব্যক্তির গায়ে অ্যাসিড ছোঁড়ার অভিযোগ উঠে।
•২০১৯, ৯ সেপ্টেম্বর: সন্ধ্যায় দাসপুর থানার সুপাপুড়শুড়ির দুই ছাত্রীর টিউশনি থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাড়ি পৌঁছানোর কিছুটা আগেই তাদের গায়ে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়।
•২০১৯, ৩ জুন: ভাইয়ের মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল দাদার বিরুদ্ধে। ওই দিন ঘাটাল থানার নকুরবাজারের বাসিন্দা শম্ভু অধিকারীর গায়ে তাঁরই দাদা অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে বলে থানায় অভিযোগ করা হয়।
•২০১৯, ১৪ মে: দুপুরে নিজের ভাইঝির গায়ে অ্যাসিড ছোঁড়ার অভিযোগ উঠে তাঁরই কাকার বিরুদ্ধে। সম্পত্তির বিবাদের জেরে। যুবতীর বাড়ি সোনাখালিতে। অভিযুক্ত কাকা দিলীপ পালকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
•২০১৯, ১৩ মে: রাতে ঘাটাল থানার দীর্ঘগ্রামের দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে অ্যাসিড ছোঁড়ার অভিযোগ উঠে। রাতে একাই একটি রুমে শুয়েছিল। সেখানেই অ্যাসিড ছোঁড়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।
•২০১৮, ৮ জুন: দাসপুর থানার জোৎকানুরামগড়ের বাসিন্দা রাজনৈতিক গণ্ডগোলের জেরে শেখ আরিফ মল্লিক নামে এক যুবকের মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার অভিযোগ উঠে।
•২০১৭, ২৮ জুন: চন্দ্রকোণা থানার কেলেমির বাসিন্দা তৃণমূলের কর্মী সৌভিক সিংহ একটি রাজনৈতিক সভা ছেড়ে বাড়ি ফিরছিলেন সেই সময় গাংচাতে তাঁর গায়ে কে বা কারা অ্যাসিড ছুঁড়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল।
•২০১৭, ১ জুন: মাঝ রাতে ঘাটাল শহরের কোন্নগরের বাসিন্দা এক কলেজ ছাত্র সুরজিৎ সাঁতরার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল তাঁরই প্রেমিকার বাবার বিরুদ্ধে। শুধু অ্যাসিড ছুঁড়েননি ওই ছাত্রকে মারধর করে সারা রাত মন্দিরে বেঁধে রাখারও অভিযোগ উঠে। প্রেমিকার মাকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। অ্যাসিড কাণ্ডের পরের দিন থেকেই প্রেমিকার বাবা পলাতক ছিল। প্রায় এক মাস পর ৩ জুলাই প্রেমিকার বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বালিডাঙাতে প্রেমিকার বাবার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
•২০১৭, ২৪ মে: রাতে ঘাটাল থানার কুশমন গ্রামে শান্তিনাথ কাবাড়ি নামে এক ব্যক্তি পুজোর দিন রাতে জানালা খোলা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত ১২টা নাগাদ তাঁর গায়ে কে বা কারা অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে।
•২০১৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি: চন্দ্রকোণা থানার উপরচাতলাবাঁধী গ্রামের বাসিন্দা এক গৃহবধূ সাইকেলে করে বাপের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন। সেই সময় তাঁর গায়ে তাঁর স্বামী ও ভাসুর অ্যাসিড ছুঁড়ে জখম করে বলে তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন।
•২০১৭, ১ জানুয়ারি: বাড়িতে সন্ধ্যা দেওয়ার সময় বন্দনা দোলই নামে এক বিধবার গায়ে অ্যাসিড ছোঁড়ার অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ঘাটাল থানার নিমপাতাতে। ওই ঘটনায় প্রতিবেশী এক যুবক গ্রেপ্তার হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ওই বিধবা মারা যান।
•২০১৬, ১৪ জুন: দাসপুর থানার আড়খানার বাসিন্দা পাঁশকুড়া কলেজের ছাত্রী ঘাটাল কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তাঁর গায়ে বাইকে করে আসা এক যুবক অ্যাসিড ছোঁড়ে।
•২০১৬, ৬ নভেম্বর: দাসপুর থানার বাণেশ্বরপুরের বাসিন্দা মহাদেব মাইতির গায়ে অ্যাসিড ছোঁড়ার অভিযোগ উঠেছিল তাঁরই প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে। সন্ধ্যায় ক্লাব থেকে ফেরার পথে তাঁর গায়ে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়। সেই সঙ্গে তাঁকে তরোয়াল দিয়ে আঘাতও করা হয় বলে অভিযোগ উঠে।
•২০১৫, ১৫ জুলাই: রামজীবনপুর শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক গৃহবধূ এবং তাঁর ভাসুরের উপর অ্যাসিড ছুঁড়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল তাঁদের প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে।
•২০১৫, ৩০ মে: মাঝ রাতে দাসপুর থানার নন্দনপুরের বাসিন্দা এক সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছাত্রী দোতলার রুমে জানালা খুলে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত দেড়টা নাগাদ ওই ছাত্রীকে লক্ষ্য করে জানাল দিয়ে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়। ওই ঘটনায় তাঁর মা ও ভাইও আংশিক জখম হন।
•এবারে শাস্তি পাওয়ার ঘটনাটি হল: ২০০৪ সালের ২২ জুলাই দাসপুর থানার বড়শিমুলিয়ার বাসিন্দা নন্দ সামন্ত ও স্ত্রী শ্যামলী সামন্ত এবং স্বদেশ সামন্ত ও তার স্ত্রী নমিতা সামন্ত যোগসাজস করে তাদের জ্ঞাতি রতন সামন্তের গায়ে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে। ঘটনার ৫০ দিন পর তথা ওই বছরই ৯ সেপ্টেম্বর রতনবাবু মারা যান।
•২০১৫’র আগেও অনেক অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। যেগুলি এখানে দেওয়া সম্ভব হল না।