কাজলকান্তি কর্মকার, ঘাটাল: ফুটবলপাগল শহর কলকাতা স্বপ্ন দেখেছিল চোখের সামনে জাদুকরকে দেখার। কিন্তু শনিবার ১৩ ডিসেম্বর যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন সাক্ষী থাকল এক চরম বিশৃঙ্খলার। লিওনেল মেসিকে কেন্দ্র করে যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় দর্শকদের ক্ষোভ, স্টেডিয়ামে ভাঙচুর এবং আয়োজকদের প্রতি ধিক্কারে। এই পুরো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি রয়েছেন, তিনি হলেন ইভেন্টের মূল উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্ত। এই প্রতিবেদনে উঠে এল ঘটনার আদ্যোপান্ত এবং নেপথ্যের তথ্যাদি।
•ঘটনার প্রেক্ষাপট: স্বপ্নভঙ্গ ও বিশৃঙ্খলা: শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে লিওনেল মেসির উপস্থিতিকে ঘিরে আয়োজিত মেগা ইভেন্টটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত ভিড় এবং প্রতিশ্রুত অনুষ্ঠান সঠিকভাবে না হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ক্ষুব্ধ জনতা স্টেডিয়ামে ভাঙচুর চালায় এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশি হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। এই ঘটনার জেরে মূল উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্তকে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হলে বিষয়টি আরও জল্পনার সৃষ্টি করে।
•কে এই শতদ্রু দত্ত? শতদ্রু দত্ত পেশায় একজন ইভেন্ট প্রোমোটার এবং স্পোর্টস মার্কেটিং উদ্যোক্তা। তিনি ‘A Satadru Dutta Initiative’ নামক সংস্থার কর্ণধার। তাঁর মূল কাজ হলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া জগত এবং বিনোদন দুনিয়ার বাঘা বাঘা তারকাদের ভারতে নিয়ে আসা।

মূলত আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি এবং ভারতীয় স্পন্সর বা দর্শকদের মধ্যে তিনি একজন ‘মিডলম্যান’ বা ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি দাবি করেন, অতীতে পেলে, দিয়েগো ম্যারাডোনা, এবং ক্যাফুর মতো কিংবদন্তি ফুটবলারদের সফলভাবে কলকাতায় নিয়ে আসার নেপথ্যে তাঁর ভূমিকাই ছিল প্রধান। সেই সুবাদেই এবার লিওনেল মেসির সফরের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে ছিল।
মেসির সঙ্গে যোগাযোগের আসল সত্য: সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, মেসির সঙ্গে কি শতদ্রু দত্তের কোনো ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব রয়েছে? উত্তর হলো—না। এই ধরনের হাই-প্রোফাইল সফরগুলো সম্পূর্ণ পেশাদার চুক্তির মাধ্যমে হয়। প্রক্রিয়াটি সাধারণত নিম্নরূপ: ১. মেসির আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট বা এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করা। ২. একটি নির্দিষ্ট ‘অ্যাপিয়ারেন্স ফি’ (Appearance Fee) বা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা। ৩. নিরাপত্তা, লজিস্টিক্স এবং

অন্যান্য শর্তাবলি মেনে চুক্তি স্বাক্ষর করা। এই সফরে শতদ্রু দত্ত ছিলেন সেই ‘লোকাল প্রোমোটার’ বা স্থানীয় সমন্বয়কারী, যিনি এই শর্তগুলো পূরণ করে মেসিকে কলকাতায় আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ইভেন্টের সম্ভাব্য বাজেট ও আর্থিক সমীকরণ: যদিও এই ইভেন্টের কোনো সরকারি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়নি, তবে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রি সূত্রে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা চমকে দেওয়ার মতো। —মেসির পারিশ্রমিক: আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা। —লজিস্টিক্স (ভেন্যু, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি): প্রায় ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা। —প্রচার ও অন্যান্য খরচ: ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই একটি ইভেন্টের বাজেট ছিল আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, এই বিশাল যজ্ঞের পুরোহিত হিসেবে শতদ্রু দত্তের সম্ভাব্য আয় নিয়েও নানা গুঞ্জন রয়েছে। সাধারণত প্রোমোটাররা মোট বাজেটের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ কমিশন হিসেবে পান। সেই হিসেবে তদন্তকারীরা অনুমান করছেন, এই ইভেন্ট থেকে তাঁর আয় ১ থেকে ৩ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে।
কেন ঘটল এই বিপত্তি?: এত বিপুল অঙ্কের বাজেট এবং আন্তর্জাতিক মানের তারকা থাকা সত্ত্বেও ইভেন্টটি কেন ব্যর্থ হলো, তা নিয়ে উঠে আসছে একাধিক গাফিলতির অভিযোগ: ১. টিকিট কেলেঙ্কারি: অভিযোগ রয়েছে, স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল, যার ফলে পদপিষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ২. নিরাপত্তায় গলদ: আন্তর্জাতিক মানের ইভেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটোকল ও নিরাপত্তা বলয়

তৈরিতে আয়োজকরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ৩. মেসি দর্শন: সবচেয়ে বড় ক্ষোভের কারণ ছিল—এত টাকা খরচ করে টিকিট কেটেও দর্শকরা মেসির সঙ্গে প্রতিশ্রুত ইন্টারঅ্যাকশন বা দর্শন পাননি।
বর্তমান পরিস্থিতি ও আইনি পদক্ষেপ: দর্শকদের বিক্ষোভ এবং স্টেডিয়াম ভাঙচুরের ঘটনার পর প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। শতদ্রু দত্তকে আটক করার পাশাপাশি পুরো ঘটনার পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছে। টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হবে কি না, এবং এই বিশৃঙ্খলার জন্য প্রশাসনিক স্তরে কার কতটা দায় ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, প্রতারণা এবং গাফিলতির দিকটি তারা গুরুত্ব সহকারে দেখছে।
শনিবারের ঘটনা কেবল একটি ইভেন্টের ব্যর্থতা নয়, এটি কলকাতার ফুটবল আবেগের সঙ্গে এক নির্মম পরিহাস। কোটি কোটি টাকার খেলা, আন্তর্জাতিক গ্ল্যামার, আর অব্যবস্থাপনার জাঁতাকলে পিষ্ট হলো সাধারণ দর্শকের বিশ্বাস। এখন দেখার বিষয়, তদন্তের শেষে আসল দোষীরা শাস্তি পায় কি না এবং ভবিষ্যতে এমন আন্তর্জাতিক ইভেন্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে শহরের ভাবমূর্তি কতটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। [তথ্য সূত্র: সংবাদপত্র এবং ইন্টারনেট]








