এই মুহূর্তে ক্রীড়া/অনুষ্ঠান অন্যান্য সাহিত্য সম্পাদকীয় নোটিশবোর্ড

E-Paper

ভারতের ফৌজদারি আদালত: হোঁচট খাওয়ার কারণ ও অদৃশ্য কৌশল

Published on: December 13, 2025 । 6:28 PM
দেবপ্রসাদ পাঠক বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবপ্রসাদ পাঠক বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘাটাল মহকুমা আদালতের একজন স্বনামধন্য বরিষ্ঠ আইনজীবী। দিনের অধিকাংশ সময় আইনের জটিল যুক্তি-তর্ক এবং পেশাগত পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, শত ব্যস্ততার মাঝে নিজের মৌলিক চিন্তাভাবনা ও সামাজিক চিত্র নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে কলম ধরতে ভালোবাসেন।
📞 +919433256773 WhatsApp

দেবপ্রসাদ পাঠক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘স্থানীয় সংবাদ’, ঘাটাল: ৯০ দিনের ফাঁকফোকর এবং ‘পরিকল্পিত গাফিলতি’—এ দেশের ফৌজদারি আইন কি সত্যিই নিরপেক্ষ? ভারতের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হওয়া আসামিকে ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়া না হলে আদালত তাকে জামিন দিতে বাধ্য। এটি আইনসিদ্ধ বিধান। কিন্তু আইনের সেই বিধান আজ ‘পরিকল্পিত গাফিলতি’র অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোচবিহারের অমর রায় খু/নের মামলায় পুলিশ যেভাবে ‘কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না’, ‘অফিসার বদলি হয়েছে’, ‘প্রমাণ যাচাই চলছে’—– এই সব অজুহাতে দিন কাটিয়েছে, তা অনেক পুরনো কৌশলের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়।


এক প্রাক্তন পুলিশ অফিসার জানান,  মাঝেমধ্যেই ৯০ দিনের মাথায় ‘হাওয়ায়’ উড়ে যায় চার্জশিট। সময় পার হলে আদালত কিছু করতে পারে না। আর অভিযুক্তরা বেরিয়ে আসে। এটাকে বলে ‘সিস্টেম্যাটিক সাইলেন্স’। সবাই এটা জানে, শুধু জানে না ভুক্তভোগীর পরিবার। অমরের ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে। পাঁচ অভিযুক্তই জামিন পেয়ে বেরিয়ে এসেছে। আর তদন্ত? সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।
•‘সময় নষ্টের’ কৌশল: আসামী, পুলিশ ও আইনজীবীর অদৃশ্য সমঝোতা: কীভাবে তৈরি হয় ‘টাইম কিলিং’ মামলা? একথা লুকোনো নয় যে দেশজুড়ে বহু কুখ্যাত মামলায় প্রশাসন ও পুলিশ একটি অদৃশ্য জোট তৈরি করে। উদ্দেশ্য একটাই—সময় নষ্ট করা। এই সময়েই নষ্ট হয় প্রমাণ, হারিয়ে যায় সাক্ষী, বদলে যায় ঘটনার বিবরণ, আর প্রবল উৎসাহে নেচে ওঠে অপরাধীরা। এর ফলে মুনাফা লোটে আসামীর আইনজীবী। আইনজীবী মহলের এক সিনিয়র সদস্য বলেন, “কেসের ফাইল গায়েব হয়, জিডি (GD) এন্ট্রি মিলছে না, আদালতে সঠিক নথি দাখিল হচ্ছে না—এসবকে বলে ‘ডিলে স্ট্র্যাটেজি’। শেষে আদালতও ক্লান্ত হয়ে যায়।” অমরের মামলায় তদন্তের গতি-প্রকৃতি, রিপোর্টের অনুপস্থিতি এবং চার্জশিট দাখিল না করার প্রবণতা—সব মিলিয়ে উত্তরটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
•রাজনৈতিক নির্দেশ ও তদন্তে ‘অদৃশ্য ব্রেক’: মামলার দিন থেকেই এলাকায় কানাঘুষি, অমর রায়কে মারার নির্দেশ এসেছে দলের ভেতর থেকেই। যাদের নাম উঠে এসেছে, তারা স্থানীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বড় নেতা। এমন পরিস্থিতিতে তদন্ত কি স্বাধীনভাবে এগোয়? পুলিশ কি সত্যিই স্বাধীন? প্রশাসন কি রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত? এক পুলিশ অফিসার নাম প্রকাশ না করে বলেন, “বড় নেতার নাম উঠে এলেই তদন্ত থেমে যায়। ওপরে ফোন আসে, ‘ফাইলটা আর এগিও না। সময় নাও।’ নিচের অফিসারদের হাতে তখন কিছুই থাকে না।” অমর রায় মামলায় যেভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বদলানো হয়েছে, তদন্ত বারবার শূন্যে ফিরে গেছে, এবং চার্জশিট নেই, তা দেখেই বুঝে ফেলছেন অনেকেই। ‘অর্ডারটা যে ওপর থেকে এসেছে, বোঝার জন্য রিসার্চ লাগে না।‘
•ন্যায়বিচার যখন স্বপ্ন: ভুক্তভোগী পরিবারের একাকিত্ব: যে পরিবার রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, যাদের ছেলে দলের কাজ করত, যাদের ঘরে প্রতিদিন গোষ্ঠীর লোকজন আসত, আজ সেই পরিবারও একা। অমরের মা, যিনি নিজেই পঞ্চায়েত প্রধান, বলেন, “দল আমাকে চেনে, আমি দলকে চিনি। কিন্তু যখন দেখলাম আমার ছেলেকে মেরেছে আমারই দলের লোক, তখন তো আমার সব ভেঙে গেল।  বাবা বলেন, আমি পুলিশকে শতবার বলেছি, তদন্ত করুন। কিন্তু কেউ শুনল না। এখন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাব। বিচার চাই।তাদের এই লড়াই এখন শুধু ছেলের জন্য নয়, এ লড়াই প্রশাসনের বিরুদ্ধে, সিস্টেমের বিরুদ্ধে, আর সেই ‘নীরবতার’ বিরুদ্ধে, যে নীরবতা বাংলার বহু রাজনৈতিক খুনের মামলায়, ধর্ষণের মামলায় আজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বাংলার সাধারণ মানুষের বড় প্রশ্ন, মানুষের জীবন কি দলের হাতের খেলনা?
•বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা ও আদালতের নিরুপায়তা: ফাইল গায়েব, আসামি ‘মৃত’ দেখানো, রেকর্ড অনুপস্থিত, ভিসেরা প্রিজার্ভ করার খুঁটিনাটি নিয়মে ইচ্ছাকৃত ভুল, ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো পোশাকের রং ও ডিজাইনের সঙ্গে মৃতার ফটোগ্রাফের মিল না থাকা, এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর বয়ান ইচ্ছাকৃতভাবে নোট না করার মতো হাজারো কারণে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে প্রকৃত অপরাধীকে

সব কিছু বুঝতে পেরেও বেকসুর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় আদালত। আর লোকে দেখে আদালত শাস্তি না দিয়ে শুধুমাত্র তদন্তকারী অফিসারদের তিরস্কার করে। আর খালাস বলেই আদালত নিজের দায়িত্ব থেকে খালাস হয়ে যায়।এটাই প্রথম নয়। বিগত বছরগুলিতে দেখা গেছে, বহু বিজেপি, আরএসএস, হিন্দু সংগঠনের কর্মীর খুনের মামলা গায়েব হয়ে গেছে, আসামি কখনও ‘মৃত’ দেখানো হয়েছে (যদিও কেউ কেউ জ্যান্ত বিদেশে পালিয়েছে), আর পুলিশ এখনও ‘ট্রায়ালের জন্য রেকর্ড খুঁজছে’। আর জি করের মামলা বা অমর রায়ের মামলায় সেই একই ব্লুপ্রিন্ট দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছা করলে প্রশাসন কাকে বাঁচায়, কাকে অপরাধী বানায়, সবই রাজনীতির অংশ। ফৌজদারি অপরাধের গোটা বিচার ব্যবস্থাই তদন্তের দাস।
•সমাজকে দেওয়া ভয়ঙ্কর বার্তা: বিচার না হলে সমাজ কী শেখে? অপরাধী বেরিয়ে আসে, পরিবার ভেঙে যায়, রাজনীতি চুপ করে থাকে, আর সুশীল সমাজ একটা ভয়ঙ্কর বার্তা পায়: “টাকা আর ক্ষমতা থাকলে আদালতও কিছু করতে পারে না।” এই বার্তাই ভবিষ্যতের অপরাধীদের আরও সাহসী করে। আর জি করের ঘটনা এবং কোচবিহারের অমর রায়ের খুন তাই শুধু এক একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, এটি বাংলার হতভাগ্য মানুষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দুর্নীতিবাজদের বিবেকহীনতার এক দুর্ঘটনাস্থল।
•বিচারের বাণী: বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও কি অধরা? মার্কিন আদালতে বাঙালি বিজ্ঞানীর স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী ভারতের বাইরের দেশগুলোও এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও নাকি বিচার পাওয়া যায় না, অনেকেরই এটা দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে? সেখানেও তো অধরা রয়ে যায় বিচার! ডিসেম্বর ২০১২, লস অ্যাঞ্জেলেস। স্থানীয় ফেডারেল আদালতে বিচারপ্রার্থী পুত্রহারা এক পিতা। দু’বছর হল বিচারের আশায় আদালতে চক্কর কাটছেন প্রবাসী এই বঙ্গসন্তান। সেপ্টেম্বর ২০১০, তাদের ষোল বছরের ছেলে ঈশান বাথরুমে দাড়ি কাটছিল। আচমকা ইলেকট্রিক শেভার থেকে জোরালো ঝটকা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে প্রাণ হারায় সে। বিজ্ঞান সাধক বাবার দৃঢ় বিশ্বাস, শেভারের ত্রুটিপূর্ণ সার্কিটের জন্যই তড়িতাহত তাদের মেধাবী সন্তান। ওই বিখ্যাত শেভার কোম্পানির বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা দায়ের করেন।
কিন্তু আদালতের জুরীরা সেকথা মানতে চায়নি। পাক্কা দুটি বছর শুনানির পর উল্টে তাদের রায়, ঈশান ছিল মাদকাসক্ত এবং নিজেকে শেষ করে দেবার উদ্দেশ্যেই সে আত্মহত্যা করেছে। এখানেই শেষ নয়, পুত্রহারা দম্পতিকে তাদের কটাক্ষ: “Okay, so during the last two years you didn’t have to pay school fees of 58,000 dollars, right?” অর্থাৎ, ওই ছেলেকে হারিয়ে তোমরা তো ভালোই আছো! আদালতের রায় শুনে বিজ্ঞানী বাবা হতাশ হয়ে পরিচিতদের কাছে বলেন, মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কী? আর যদি আমরা মামলাটা জিততামও, টাকাই না হয় ধার্য হতো আমার মৃত পুত্রের জন্য, তাকে তো কোনোদিনও ফিরে পেতাম না!
•ডক্টর বেদব্রত পাইন: এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি: মা সোনালী কিন্তু লড়াই ছেড়ে দেননি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ঐ কোম্পানির প্রোডাক্ট না কেনার জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। দাবি করেছেন বাজার থেকে তুলে নিতে হবে ঐ মডেলের শেভার। এই দম্পতি হলেন ডক্টর বেদব্রত ও তাঁর স্ত্রী সোনালী পাইন। ডক্টর বেদব্রত পাইন সেন্ট লরেন্স ও সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রাক্তনী। মাধ্যমিকে তৃতীয় ও উচ্চমাধ্যমিকে দশম স্থান অধিকার করে ভর্তি হন আইআইটি খড়্গপুরে। ইলেকট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক হবার পর দুষ্প্রাপ্য আইভি লীগ স্কলারশিপ পেয়ে ভর্তি হন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে প্রথমে এম.এস এবং পরে পিএইচডি করেন। ১৯৯৩ সালে যোগ দেন নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবে। সেখানে উদ্ভাবন করেন সিএমওএস (CMOS) সেন্সর যা মোবাইল ও ডিএসএলআর (DSLR) ক্যামেরায় অপরিহার্য। তার আবিষ্কৃত অ্যাক্টিভ পিক্সেল সেন্সর টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম ক্যামেরা এবং উন্নত স্পেশ টেলিস্কোপ। এই উদ্ভাবন তাঁকে ইউএস স্পেস টেকনোলজির ‘হল অব ফেম’-এ জায়গা করে দিয়েছে। তিনি প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি টেকনিক্যাল পেপার্স প্রকাশ করেছেন এবং অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। পনেরো বছর

সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করার পর, ২০০৮ সালে নাসা ছাড়বার সময় তাঁর ঝুলিতে ছিল ৮৭টি আবিষ্কারের পেটেন্ট! তারপর থেকেই সপরিবারে ডক্টর পাইন লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দা। এতো কিছুর মধ্যেও স্ত্রী সোনালীর (রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) সাথে যৌথভাবে পরিচালনা করেন পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা “#আমু”। কাশ্মীর নিয়ে বই লিখেছেন ‘Behind the events in Kashmir’। কিন্তু আমজনতা তাকে চেনে চিটাগং ছবির প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে। চট্টগ্রামে জন্ম পিতার কাছ থেকে শোনা অগ্নিঝরা সেই দিনগুলোর কথা ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিল তাকে। স্বপ্ন দেখতেন এই বিদ্রোহ নিয়ে একদিন ছবি করবেন। ২০১৪ সালে সাকার হয় তার স্বপ্ন। পুত্র ঈশান চেয়েছিল সেও অভিনয় করবে এই সিনেমায়, কিন্তু বিধাতা পুরুষের ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। তবে হতভাগ্য বাবা ছবিটি উৎসর্গ করেছিলেন প্রয়াত পুত্রের নামে। অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপেয়ী ও নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী, এমনকি পর্দায় উপস্থিত হয়েছেন প্রাক্তন চট্টগ্রাম বিপ্লবী স্বয়ং সুবোধ রায়। নাসায় থাকাকালীন তার আবিষ্কৃত ডিজিটাল ইমেজিং টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে ছবিটিতে, যা ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম। অবশ্য সিনেমা রসিকদের প্রশংসা এবং জাতীয় পুরস্কার পেলেও, বলিউড লবির ইশারায় বাণিজ্যিক সফলতা পায়নি ছবিটি।
এক জীবনে এতো কিছু পেয়েও বাঙালির এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বেদব্রত হারিয়েছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এখন শুধু কনিষ্ঠ পুত্র ভিভানকে নিয়ে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখা।

নিউজ ডেস্ক

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।