“মকদম সাহেব  ডিহিপলসা”        —উমাশংকর নিয়োগী 

“মকদম সাহেব  ডিহিপলসা”        —উমাশংকর নিয়োগী
[সুনিবিড় ছায়া ঢাকা পল্লীবাংলার বুকে কত না অজানা কাহিনি আজও তার রহস্যময়তা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে তার ইয়ত্তা নেই । পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার  দাসপুর ১নং  ব্লকের  রাজনগর গ্রামপঞ্চায়েতের বেশ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে দাঁড়ালে ভাঙ্গা  চুনসুরকির ইমারত, মন্দিরের ভেঙ্গে পড়া ইটের  স্তুপ, বিস্তীর্ণ জলাশয়  ফিসিফিসিয়ে কথা বলবে, জানাতে চাইবে  তাদের    ইতিকথা ।  আজ আমরা এমনি একটি গ্রামে যাব । আদিগন্ত শস্য দিয়ে ঘেরা ছায়াসুনিবিড়  গ্রামটির  নাম  ডিহিপলসা । ঘাটাল পাঁশকুড়া বাস রাস্তায় এসে  দাসপুর বকুলতলায়  নামতে হবে  । এখান থেকে আবার  মেদিনীপুর যাওয়ার পথে বাস  বা  টোটো  ধরে প্রায় পাঁচ কিলো মিটার দূরে ডিহিপলসা গ্রামের বাসস্টপে নামুন ।  মেদিনীপুরের থেকে এলে রাজনগরের পরেই ডিহিপলসা।]
        ডিহিপলসা গ্রাম  নামের উৎস খোঁজ করলে দেখা যাবে ফারসি শব্দ ‘দিহ্‌’ থেকে ডিহ > ডিহি শব্দের উৎপত্তি । ফারসি শব্দে দিহ্‌ অর্থে শাসকের বাসস্থানকে  বোঝায় । পলসা শব্দটি সম্ভবত পল্লশাহী  ( পল্লশাহ> পলসা )  শব্দ থেকে এসেছে । পল্ল অর্থ শস্যগোলা আর শাহী  শাসকের,  রাজার । হয়তো এই গ্রামে কোন  এক সময়ে রাজার শস্য গোলাতে  মজুত থাকত । লক্ষনীয় বিষয় হল ডিহিপলসা গ্রামের পাশের গ্রামের নাম  আনন্দগড় ।  জনশ্রুতি এক সময়ে আনন্দ নামে এক প্রাচীন  রাজার গড় ছিল এটি ।   আনন্দগড়ের  বিস্তীর্ণ বনভূমিতে বেশকিছু প্রমাণ এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আনন্দগড়ের সংলগ্ন ডিহিপলসা গ্রামে কায়স্থ রায় ও বসুদের বসবাস ছিল । বর্তমানে  রায় ও বসু পরিবারের কেউ আর এই গ্রামে বসবাস করেন না । তাঁরা অনত্র বসবাস করেন । বাস্তু , জমি ইত্যাদির মালিকানা হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছে।  এদের  পরিত্যক্ত রাজরাজেশ্বরীর   মন্দির , বড় বড় জলাশয় ,  ইমারতের ধ্বংসাবশেষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য দিতে ।
ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে  সুফীসাধক  আব্দুল কুদ্দুস জন্ম গ্রহণ করেন ।  সুফীবাদে বিশ্বাসী আব্দুল কদ্দুস যে কোন কারণেই হোক বাগদাদ ছেড়ে ভারতের দিল্লিতে চলে আসতে বাধ্য হন  ।   দিল্লি থেকে বাংলাদেশের  রাজশাহীর শাহাজাদপুরে  আস্তানা করে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন ।  ভারতে আসার পর থেকেই তিনি শাহ  মকদুম  নামে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন । তাঁর বহু অনুগামী শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ভারতের  বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়েন  । মকদুম শাহের ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে  জীবনাবসান হয়।         ইংরেজ শাসনকালে  ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত  সারা পূর্ব ভারত জুড়ে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ  বিক্ষিপ্ত ভাবে সঙ্ঘটিত হয়।ইতিহাসের পাতায় এই বিদ্রোহ  ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত ।  আমাদের ঘাটাল মহকুমার ক্ষীরপাইয়ে  স্বামী শিবানন্দের নেতৃত্বে ১৭৭৩  খ্রিস্টব্দে সন্ন্যাসী [খবর সংক্রান্ত ভিডিও দেখুন] বিদ্রোহ চরম আকার নেয় । ইংরেজ সেনা নায়ক ক্যাপটেন এডওয়ার্ড  বিদ্রোহ দমন করতে এসে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যান ।  মকদুম শাহের অনুগামী বহু ফকির এই বিদ্রোহে সঙ্গে  যুক্ত হয়ে ছিলেন  ।  পরে শিবানন্দ আত্মগোপন করলে  বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।  প্রসঙ্গত বলা যায় হুগলী জেলার গোঘাটে  বালি গ্রামপঞ্চায়েত এলাকার ভাদুরে  প্রতি বছর  ৫ই মাঘ একটি তেঁতুল গাছের নীচে থাকা    শাহ মকদুম /মকদম  বাবার মাজার কেন্দ্র করে বিশাল  উরসের আয়োজন করা  হয়।উরস হলেও  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির  উৎসব বলে মেনে নিয়ে   হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই  সামিল হন । শোনা যায় এই উপলক্ষে  লক্ষাধিক  মানুষের সমাগম হয়ে থাকে । সকলের জন্য দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থার বিপুল আয়োজন থাকে ।
রাজনগর গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায় কোন মুসলমান পরিবার বসবাস করেন না  অথচ   ডিহিপলসা , রাজনগর এবং আনন্দগড়  তিনটি গ্রাম যেখানে এসে মিলেছে সেখানেই একটি শেওড়া গাছের তলায় ডিহিপলসা গ্রাম সীমানায় কৃষ্ণপদ মাইতির জায়গায়  মকদম সাহেবের অধিষ্ঠান । ডিহিপলসা গ্রামের রাজরাজেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন একটি পুকুর মকদম শাহের > সাহেবের  পুকুর নামে পরিচিত ।  অশীতিপর  গ্রামবাসীদের  মুখে শোনা গেল তাঁরা  পুর্বপুরুষের  কাছে শুনেছেন  শতশত বৎসর পূর্বে  শোভা সিংহের সময় কোন এক আগন্তুক ঘোড়ায় চড়ে এসে এই শেওড়া গাছের নীচে দেহত্যাগ করেন । আবার কারো কারো মতে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের  পরে এই আগন্তুক এখানে আসেন ।  রায় ও বসু পরিবারের সম্মতিতে এখানেই তাঁকে সমাধি দেওয়া হয় ।   কেউ  কেউ তাঁকে মক সাহেব বলেন , অবশ্য বর্তমানে এই মকদম সাহেব নামেই সুপরিচিত।
বহু প্রাচীন এই গ্রামের  গ্রাম্যদেবী  মা শীতলা । প্রতিবছর নিয়ম করে এই মায়ের দেশপূজা হয়ে আসছে । রীতি অনুসারে  শীতলা মন্দির থেকে পুরোহিত মশাই  বাদ্যবাজনা সহকারে এই শেওড়া গাছের তলায় এসে  পূজা চড়িয়ে  তবে শীতলা মায়ের মাথায়  ফুল চাপিয়ে গ্রামের মঙ্গল কামনা করেন । অনেকে এই শেওড়া গাছের তলায় মস্কামনা  পূর্ণ হলে পাকা সিন্নি তথা বাতাসা দিয়ে মানত শোধ করেন  ।  ডিহিপলসার রায় পরিবারের  বঙ্কিম রায় , কৃষ্ণপদ রায় বা পশুপতি  রায়দের কেউ একজন  শতাধিক বছর পূর্বে  অক্ষয়তৃতীয়ার দিন এই সমাধির কাছে শেওড়া তলায়  কাঁচাসিন্নি দিতে আরম্ভ করেন ।   সেই  থেকে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন এখানে কাঁচাসিন্নি দেওয়ার  চল হয়ে যায় ।  এই ভাবেই চলে আসছিল। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে  কানাই সামন্তের নেতৃত্বে ডিহিপলসা, আনন্দগড় ও রাজনগর গ্রামের সমবেত মানুষজন   অক্ষয়তৃতীয়ার দিন অষ্টপ্রহর  হরিনাম  সংকীর্তন এবং নরনারায়ণ সেবার ব্যবস্থা করেন । সেই থেকে ধারবাহিক ভাবে  চলে আসছিল  কিন্তু করনার কালে দুবছর বন্ধ হয়ে যায় ।
গ্রামবাসীরা জানালেন এই শেওড়া  গাছের  আজ পর্যন্ত কোনরূপ  হ্রাসবৃদ্ধি  তাঁরা দেখেননি  ।  গাছের তলায় স্তুপাকৃতি  অগুনতি ছোটবড় মাটির ঘোড়ার স্তুপ এই মকদম সাহেবের মনস্কামনা পূর্ণ করার অলৌকিক ক্ষমতা  ও  প্রাচীনত্ব সূচিত করে।  অক্ষয়তৃতীয়ার আগেরদিন থেকে কেশপুরের  আনন্দপুর থেকে কুমোরেরা মাটির ছোটবড় ঘোড়া নিয়ে চলে আসেন। মকদম  সাহেবের পুরোহিত লক্ষ্মীকান্ত চক্রবর্তী জানালেন মকদম সাহেবের গাছতলায়    এই তিন গ্রামের প্রতি ঘর থেকে   অক্ষয়তৃতীয়ার দিন পূজা তো আসেই তাছাড়া  বহু দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন তাদের মানসিক শোধ করতে ।প্রায় ছসাতশো পাকাকলা , ৩৫ – ৪০  কেজি আটা ও চিনি সম পরিমাণে দুধ দিয়ে সত্যনারায়ণের  সিন্নি প্রস্তুত হয় এদিন। এই প্রসাদ  যাত্রী সাধারণের মধ্যে বন্টিত হয়।    জনসাধারণ ও গ্রামবাসীগণের সার্বিক সহায়তা ও  স্বেচ্ছাশ্রমে এই উপলক্ষে প্রায় দশপনেরো হাজার  নরনারায়ণ  যাতে অন্নপ্রসাদ  গ্রহণ  করতে পারেন  তার ব্যবস্থা থাকে ।
শেওড়া গাছের তলাটি  সিরামিক  টালি দিয়ে বাঁধানো । সামনে থাকা মাইতি  পরিবারের সদাজাগ্রত পরিষেবায় স্থানটি খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ভক্তি উদ্রেকোচিত।  অক্ষয়তৃতীয়া কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে  সমস্ত কিছু দেখাশোনা করার জন্য  মূলত তিন  গ্রামের প্রতিনিধি নিয়ে  একটি কমিটি আছে ।   কৃষ্ণপদ মাইতি , বিজয়কৃষ্ণ সামই , কৃষ্ণপদ সামন্ত  , কানাই সামন্ত , অজয়কুমার দাসঠাকুর , লক্ষ্মীকান্ত দাসঠাকুর প্রমুখ কমিটির সদস্যরা জানালেন  তাঁরা মকদম সাহেবের যথাযথ সেবা চলার  জন্য  অচিরেই একটি ট্রাস্ট গঠন করবেন ।   আমারা যখন অনেকেই সাম্প্রদায়িক ভেদভাবনার বিষবাষ্পে জর্জরিত তখন মকদম সাহেবকে কেন্দ্র করে চলে আসা রীতিনীতি  প্রমাণ করে দিয়েছে এখনো কিছু মানুষ,  মানুষ পরিচয় নিয়েই বাঁচতে চান ।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।