‘শীতলানন্দশিব মন্দির রামনগর’
উমাশংকর নিয়োগী:পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার রামনগর গ্রামের পঞ্চরত্ন [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন] শীতলানন্দশিব মন্দিরটি গঠনগত দিক থেকে এবং টেরেকোটার ফলক বৈচিত্র্যের দিক থেকে খুবই গুরুত্ব পুর্ণ। মন্দিরময় দাসপুর । টেরেকোটা শোভিত বহু বিষ্ণু মন্দির দেড়শো দুশো বছরকে অনায়াসে তুড়ি মেরে, দাসপুরের গৌরবময় অতীতের সাক্ষী দিতে বহুক্ষেত্রে অবহেলা অনাদর রোদ জল উপেক্ষা করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ইতিমধ্যে অনেক মন্দির কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। বিষ্ণুমন্দির ছাড়া টেরেকটার ফলক যুক্ত সুরথপুরে পঞ্চরত্ন একটি শীতলা মন্দির। রামনগরে শীতলানন্দ শিবের পঞ্চরত্ন ও হরিরামপুরের শীতলানন্দ শিবের আটচালা দুটি প্রাচীন শিব মন্দির আছে। অতি সম্প্রতি শ্যামসুন্দরপুরে নব নির্মিত শিব মন্দিরে কৃষ্ণনগর থেকে কিছু পোড়া মাটির ফলক নিয়ে এসে লাগানো হয়েছে ।
আমরা আজ রামনগরের শিব মন্দিরটি দেখার চেষ্টা করব। ঘাটাল পাঁশকুড়া রাস্তা ধরে এসে বেলেঘাটা বাসস্টপেজ থেকে পূর্বমুখী রাস্তায় প্রায় চার কিলোমিটার দূরে রামনগর গ্রাম।এই গ্রামে সুদূর অতীত থেকে বেশ কিছু সম্পন্ন পরিবার বসবাস করে আসছেন। এক সময়ে পাট ব্যবসা করে এই গ্রামের সতীশচন্দ্র বেরা পরিবারের কোন এক পূর্ব পুরুষ প্রভূত ধনসম্পদ অর্জন করেন । ধর্মপ্রাণ বেরা মশাই এই শিব মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটির সামনে প্রশস্ত আটচালা এর অনতিদূরে বড় পুকুরটি এক সময়ে শিবের পুকুর ছিল । পঞ্চরত্ন শিব মন্দির দাসপুর থানায় এই একটিই আছে। সচেতনার অভাবে মন্দির সংস্কারের সময় অবহেলা বশত কাল জ্ঞাপক লেখাটি সহ বহু ফলক নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় মানুষ উত্তমকুমার সাউ গোপাল চন্দ্র মাইতিরা মনে করেন কালের ক্ষত নিয়ে দেবালয়টি দুশো বছরের বেশি দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে মন্দিরটি কেবল বেরা পরিবারের সম্পদ নয় পাশাপাশি পাঁচটি গ্রামের মানুষের এই শীতলানন্দ শিব ।পঞ্চ গ্রামের সার্বিক সহায়তায় ধুমধাম সহকারে শিবের গাজন উৎসব ও দেব সেবা চলছে।
এই মন্দিরগুলি আমাদের দাসপুরের ইতিহাসের একেকটি পাতার মত। মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে প্রতিষ্ঠাতার ধর্মবোধ, মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশের প্রয়াস , সামাজিক দায়বদ্ধতা , তাঁর সাংস্কৃতিক চেতনা , সৌন্দর্য বোধ দর্শকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠা না করে জনসাধারণের দেবতা শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাতে গাজনের সময় কিছু দিনের জন্য হলেও নারী পুরুষ, জাতি নির্বিশেষে সকলেই শিব পূজার অধিকার পায়। শীতলানন্দ শিব মন্দিরের বেশ কিছু অমূল্য টেরেকোটা নষ্ট হয়ে গেলেও এখনো যা আছে তা দাসপুরের গর্বের বিষয় । পশ্চিমমুখী পঞ্চরত্ন মন্দিরটি ইটের, চুনসুরকি দিয়ে গাঁথা। কয়েক বছর আগে সিমেন্ট বালি দিয়ে মন্দিরটি প্লাস্টার করা হয়েছে। খিলান যুক্ত তিনটি প্রবেশ পথ। মূল মন্দিরে ঢোকার একটি দরজা।এই খিলান যুক্ত তিনটি প্রবেশ পথের উপরে রামায়ণ, কৃষ্ণ কথা এবং শিবপুরাণের নানা কাহিনি স্থান পেয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে এই মন্দিরে চণ্ডী মঙ্গল কাব্যের কমলে কামিনীর ফলক নেই । দক্ষিণ দিকের দ্বারপথের খিলানের উপরে নৌকাবিলাস, গোপিনীদের বস্ত্র হরণ, হরপার্বতী , গরুড়ের কাঁধে চতুর্ভুজ বিষ্ণু , একেবারে উপরে ভিক্ষুক শিবকে ভিক্ষা দিচ্ছেন অন্নপূর্ণার টেরেকোটার ফলক আছে। একটি ময়ূর স্থান পেয়েছে এই দ্বার পথে। মূল দ্বার পথের খিলানের উপর মারীচবধ, রামরাবণের যুদ্ধ, লক্ষ্মণ হীন রাম সঙ্গে হনুমান, রাবণের দাশমাথা কুড়িহাতের এক হাতে তরবারি ,খঞ্জর রাবণের প্রধান শস্ত্র। অনুমান এক সময়ে খঞ্জর > খাঞ্জার > খাঞ্জাপুরে উৎকৃষ্ট মানের তরবারি তৈরি হত বলেই রাবণের হাতে বৃহৎ খঞ্জর। রামের বালি বধ, ত্রিজটার হনুমান ভক্ষণের ফলক আছে । উত্তর দিকের প্রবেশ দ্বারের খিলানের উপর টেরেকোটা ফলকগুলি সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এখানো যে ফলকগুলি কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে টিকে আছে সেইগুলির মধ্যে সবাহন শীতলা , দুই সন্তান সহ মা , মনসা , হেঁতালের লাঠি সহ চাঁদ সদাগর , মহাদেব সহ চতুর্ভুজা কালী, সবাহন গণেশ ইত্যাদি।
প্রবেশ পথের মধে থাকা দুটি থামের নীচে একসারি ফলক থাকলেও উপরে কোন টেরেকোটার ফলক নেই । সম্ভবত সংস্কারের সময় এগুলি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। মন্দিরের সম্মুখ ভাগের দক্ষিণ ও উত্তর দেয়ালের টেরেকোটা ফলকগুলি এখনো অক্ষত আছে। দাসপুরের প্রতিটি টেরেকোটা ফলক যুক্ত মন্দিরে দশাবতারের ফলক থাকা আবশ্যিক বিষয় । গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবের দশাবতার বন্দনায় জগন্নাথ না থাকলেও দাসপুরের প্রতিটি মন্দিরের টেরেকোটা ফলকে জগন্নাথ দশ অবতারের এক অবতার হিসেবে স্থান পেয়েছেন। এক সময়ে মেদিনীপুর জেলা উড়িষ্যা রাজের অধীন ছিল তা ছাড়া জীবনের বেশকিছু বছর চৈতন্যদেব নীলাচলে কাটিয়েছেন । স্বভাবত এখানকার মানুষ জগন্নাথদেবের দ্বারা সমধিক প্রভাবিত হয়েছে। দাসপুরের অন্যান্য মন্দিরের সঙ্গে রামনগরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরের দশাবতারের পার্থক্য আছে। এখানে এক অবতার হিসেবে বাঁশি ও চক্র হাতে ব্যতিক্রমী কৃষ্ণ , জগন্নাথ আছেন ।দাসপুরের কোন মন্দিরে বুদ্ধ অবতার হিসেবে স্থান পাননি। এই মন্দিরটিতে ধ্যানমন্ত্র অনুসারে সবাহন কল্কি ফলকে স্থান করে নিয়েছেন। বরাহ , বামন ও বুদ্ধ পরিত্যক্ত হয়েছে। থামের নীচের অংশে সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার ফলক বেশি আছে । উত্তর দেয়ালে একটি ফলকে এক্কাগাড়িতে সম্ভ্রান্ত অরোহী কোথাও চলেছেন । সিদ্ধি ঘোঁটা মায়ার রজ্জুতে বন্ধন ইত্যাদি অন্যান্য মন্দিরের মত এখানেও আছে। দাসপুরের অন্য কোন মন্দিরে এত সৈন্যের বাহুল্য নেই। জোব্বা পরা মাথায় পাগড়ি তরবারি হাতে নবাবী সৈন্য যেমন দেখতে পাবেন তেমনি পায়ে বুট কোট প্যান্ট মাথায় হেলমেট পরে হাতে আক্রমণ উদ্যত বেয়নট যুক্ত বন্দুক নিয়ে একদল কুচকাওয়াজ রত ইংরেজ সৈন্যের দর্শন পাবেন । পলাশির যুদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠাতাকে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়। ভাবতে অবাক লাগে দাসপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেবালয় গাত্রে সারা বাংলার কেবল বাংলার নয় সারা ভারতের ইতিহাস টেরেকোটার ফলক দিয়ে লিপিবদ্ধ করে রেখে গিয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
এই মন্দিরের ফলকে স্থান পেয়েছে এক্কা গাড়ি , হাতির উপর হাওদায় বসা রাজ পুরুষ । ঘোড়ায় চড়ে বল্লম দিয়ে বাঘ শিকার , জলদস্যুদের জাহাজ। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে ঘাটাল মহকুমার আর কোনো মন্দির গাত্রে জলদস্যুদের জাহাজ নেই । হাতে তরবারি মাথায় জলদস্যু টুপি, মাস্তুলে ওঠার দড়ির সিঁড়ি , জাহাজের ভিন্নতর গঠন, জাহাজের গায়ে নকশা সবই নিখুঁত ভাবে শিল্পী টেরেকোটা ফলকে বাস্তবায়িত করে গিয়েছেন। থামের নীচের অংশে সামাজিক ঘটনা মূলত স্থান পেলেও এখানেও কৃষ্ণ কথা চলে এসেছে। একটি ফলকে কৃষ্ণ মথুরা থেকে ফিরে যাচ্ছেন রথে। ব্যথিত মথুরার জনতা তাঁকে যেতে দিতে চায় না। তাঁর পথ অবরোধ করেছে । মথুরার পুরবাসী এক মহিলা রথের সামনে শুয়ে পড়ে পথ অবরোধের চেষ্টা করছে। মন্দিরটির আর্চে দুস্তরে মোট ছেচল্লিশটি ফলক আছে। এর মধ্যে ‘মণি’ মুর্তি সহ বেশ কিছু মিথুন ফলক আছে। অন্যান্য ফলকগুলির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। কোন বিশেষজ্ঞের আগমন অপেক্ষায় রয়েছে ফলকগুলি। মন্দিরটির পঞ্চ চুড়ার প্রধান চূড়াটিতে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে । এটি পরবর্তিকালে সংযোজিত।
অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ মন্দির ভাস্কর্যে প্রতিফলিত সমাজচিত্র’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “ ক্ষেত্রানুসন্ধানকালে বীরভূম জেলার ইটান্ডা গ্রামের এক পরিত্যক্ত জোড়বাংলা কালী মন্দিরের সামনের দেওয়ালে দুটি মাত্র মনসা ফলক ছাড়া আর কোন লৌকিক দেবদেবীর প্রতিরূপ আমরা কুত্রাপি দেখিনি ।” দাসপুরের রামনগরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরের টেরেকোটায় হেঁতালের লাঠি হাতে চাঁদ সদাগর দাঁড়িয়ে আছে আর আছে সর্প অলংকারে বিভূষিতা মনসা, পাশেই আছেন সবাহন শীতলা । ধ্যানমন্ত্র মত এক হাতে ঝাঁটা আর কোমরে বিষের কলসি। পাশে মগ রাজার কাহিনি মোতাবেক এক জননী দুই পুত্র সহ একটি ফলক । জানি না পশ্চিমবঙ্গের আর কোন মন্দিরে শীতলার টেরেকোটা ফলক আছে কিনা ! না থাকলে, এই মন্দির সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একটি অনন্য প্রত্ন সম্পদ।
দেবালয়গুলি ধনী ব্যবসায়ী অথবা জমিদার শ্রেণির দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। জমিদার ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের আভিজাত্যের প্রমাণ তুলে ধরতে লৌকিক দেবদেবীদের আমল দিতে চাইতেন না । তাই মন্দির গাত্রে শীতলা মনসা ইত্যাদি লৌকিক দেবীর স্থান পাওয়া খুব বিরল ঘটনা। এমনকি সুরথপুরের বহু টেরেকোটা শোভিত শীতলা মন্দিরে শীতলা নেই। পিতা কৃষক পুত্র ব্যবসা করে ধনী হয়ে মন্দির তৈরি করতে গিয়েও কৃষক বা কৃষিকে গুরুত্ব দিতে চাননি । দাসপুরের কোন মন্দিরের গায়ে কৃষক বা কৃষি সংক্রান্ত কোন ফলক স্থান করে নিতে পারেনি।অথচ দাসপুরের অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে ছিল কৃষক ও কৃষি । ব্যবসাদার ও জমিদার এদের কাছে কৃষক অবহেলিত ঘৃণিত থেকে গিয়েছিল। এদিক থেকে বিচার করলে রামনগরের সতীশচন্দ্র বেরা পরিবারের পূর্ব পুরুষ নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী মানুষ । তিনি তাঁর দেবালয়ে সাধারণ মানুষের দেবী শীতলা মনসাকে স্থান দিয়ে অনন্য নজির সৃষ্টি করে গিয়েছেন ।
পূর্ব পুরুষ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মধ্যে অধিকাংশের শ্রদ্ধা বোধ নেই । প্রপিতামহের নাম জিজ্ঞাসা করলে অনেকেই আমতা আমতা করবে। যেখানে নিজের পূর্ব পুরুষ সম্পর্কেই কোন আগ্রহ নেই সেখানে তাঁদের সৃষ্টির প্রায় কোন মূল্য নেই এদের কাছে। ইতিহাস বিমুখীনতা আমাদের অস্ত্বিতের সংকট ডেকে আনতে পারে । সকলের কাছে বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা আছে। আপনারা এই মন্দিরগুলিকে দেখুন দেখে গর্বিত হন, কীভাবে এগুলিকে বাঁচানো যায় তার কথা ভাবুন আর পাঁচ জনকে ভাবতে বাধ্য করুন। রামনগরের শীতলানন্দশিব মন্দিরটি কেবল পঞ্চ গ্রামের সম্পদ নয় আমাদের সকল দাসপুর এবং ঘাটাল মহকুমার অধিবাসীর সম্পদ ও অহংকারের মন্দির। পল্লী বাংলার সবুজ আঁচলে ঢাকা মন্দিরটির আশু সংরক্ষণ প্রয়োজন । না হলে অচিরে হারিয়ে যাবে এই অমূল্য সম্পদ। •ছবিগুলি দাসপুরের নির্মল মাইতির সৌজন্যে প্রাপ্ত