‘তৃণমূল কংগ্রেস ও জেলার তিন তৃণমূল নেতা’
শ্রীকান্ত পাত্র, সাংবাদিক, ‘সংবাদ প্রতিদিন’: কিছুদিন আগে একটি অডিও নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে (অডিওর সত্যতা যাচাই করা হয়নি) ঘাটাল ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি দিলীপ মাজি তাঁর এক ঘনিষ্ঠকে দলের নেতা-নেত্রীকে এক হাত নিয়ে বলছে, দলটা আর করতে ভালো লাগছে না। এই অডিও ভাইরাল হয়ে পৌঁছে যায় দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায়র পার্ক স্ট্রিট অফিসে। এক প্রকার ধমক দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয় দিলীপ মাজিকে। তার আগে আর এক নেতা শঙ্কর দোলইয়েরও একটি অডিও ভাইরাল হয়ে পৌঁছে যায় সেই দলের সেনাপতির অফিসে। ওই অডিওরও সত্যতা যাচাই করা হয়নি। কিন্তু সেই ভাইরাল হয়ে যাওয়া অডিওর জেরে শঙ্কর দোলইকে দলের চেয়ারম্যান পদ খোয়াতে হয়। ওই অডিওতে ঘাটালের সেলিব্রিটি সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেবর বিরুদ্ধে কাটমানি নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। ফলে দলীয় নেতৃত্বের কোপে পড়তে হয় শঙ্করকে। তারও আগে শালবনীর বিধায়ক মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতোকে দলের তারকা বিধায়ক সাংসদদের বিরুদ্ধে বিষদগার করতে দেখা গিয়েছিল। সেই অডিও ভাইরাল হয়ে খোদ নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাতে পড়ে। তাঁর কী পরিণতি হয়েছিল সবাই জানি। ফেলে দেওয়া থুথু চাটতে বাধ্য করা হয়েছিল শ্রীকান্তকে।
প্রশ্ন, ওই তিন নেতা কী শুধুই আবেগের বসে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন নেতা নেত্রীদের বিরুদ্ধে? না তাঁদের অভিজ্ঞতার নিরিখে যন্ত্রণা প্রকাশ করে হালকা হতে চেয়েছিলেন? আমরা যাঁরা দীর্ঘদিন কলম পেশার সঙ্গে যুক্ত বেশ ভালো করেই জানি এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে হাজার হাজার তৃণমূল নেতা কর্মী রাতে শুতে যায়। সকালে উঠে দেখেন তাঁর পদ কেউ দখল করে নিয়েছে। এই যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, একশো দিনের কাজে হাজার অনিয়ম, বালি, কয়লা, গরু পাচার নিয়ে হাজারও প্রশ্নের মুখে গোটা দল তা কি ভালো চোখে দেখছেন নিচু তলার থেকে জেলা স্তরের নেতা কর্মীরা? শিক্ষা মন্ত্রী থেকে খাদ্য মন্ত্রী আর বিধায়ক দুর্নীতির দায়ে জেলের ঘানি টানছেন তাকে কি ভালো চোখে দেখছেন হাজার হাজার নেতা কর্মী? আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে আচমকা দেখলেন তিনি এক পদ হীন নেতা। এই সব অনিয়ম বেনিয়ম নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে আলোচনা করাটা কিন্তু স্বাভাবিক। শুধুই এই দিলীপ, শঙ্কর বা শ্রীকান্ত নয় এমন হাজার হাজার দিলীপ শঙ্কর শ্রীকান্ত এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে ঘনিষ্ট মহলে প্রকাশ করে হালকা হতে চান। একদম খাঁটি সত্যি কথাটাই বলে ফেলেন দিলীপ-শঙ্কর-শ্রীকান্তরা। পরে নেতার লাল চোখের সামনে দাঁড়িয়ে বা মিডিয়ার সামনে ঢোক গিলে বলেন, ওটা তাঁর কণ্ঠস্বর নয়। চক্রান্ত করে বিকৃত করা হয়েছে। বা প্রযুক্তির সাহায্যে নিয়ে তাঁর কণ্ঠে বসানো হয়েছে। নেতা নেতৃত্বের কাছে এতটাই ভীত যে সত্যি কথাটা বলেও ঢোক গিলতে হচ্ছে বা ফেলে দেওয়া থুতু চাটতে হচ্ছে দিলীপ-শ্রীকান্তদের। এভাবেই চলছে তৃণমূল কংগ্রেস। কোনও অন্যায় না করেও দুর্নীতির দায় নিতে হচ্ছে নিচু তলার কর্মীদের। কান পাতলেই শোনা যায় তৃণমূল নেতা কর্মীদের বুকের যন্ত্রণা। যেভাবে দল ও সরকার চলছে তাতে যে দলীয় নেতা কর্মীরা ভালো মনে নিচ্ছে না এই অডিওগুলিই তার প্রমাণ। অলিতে গলিতে যখন একান্তে নেতা কর্মীরা কথা বলেন তখনই তাঁদের গলায় উঠে আসে একরাশ যন্ত্রণা। সত্য জেনেও বুকে হাত চেপে ঢেকে রাখেন চাপ চাপ কষ্ট। আসলে মুসোলিনি ও হিটলারি কায়দায় যে দল চলছে আড়ালে আবডালে মানছেন অসংখ্য নেতা কর্মী। তৃণমূল নেতা কর্মীরা অভিষেক বন্দোপাধ্যায়কে নেতা হিসাবে মানেন? কোনও যোগ্যতা ছাড়াই অভিষেককে ‘দলের সেনাপতি’ বলে গলা ফলাতে হয় মানস ভূঁইয়ার মতো নেতাকেও। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন দেখবেন, ফ্যাসিস্ট দলের নির্দেশই ছিল নেতাকে মহত্ব দিয়ে প্রচার দিয়ে সর্বশক্তিমান প্রমাণ করে জন সমক্ষে তুলে ধরতে হবে। বলতে হবে Mussolini is always right. ইতিহাস বলছে মুশোলিনীর বিরোধিতা মানেই গুম হয়ে যাওয়া। যেমনটি হলো রাজনৈতিক মৃত্যু। অসংখ্য তৃণমূল নেতা কর্মীর প্রশ্ন দলে গণতন্ত্র আদৌ আছে? যোগ্যতার বিচার হয়? দলটা দলের মতো চলছে? এসবই সুযোগ পেলেই ফুটে বেড়িয়ে পড়ে। অডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়া তিন নেতার মুখ থেকে হাজার নেতা কর্মীর হৃদয়ের কথাই ফুটে উঠেছে।
এক শ্রেণির নেতা কর্মীর ভূমিকা মানতে পারেননি নিচু তলার কর্মীরা। মনে আছে, ‘দলের সেনাপতি’ বলে খ্যাত অভিষেক বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন, ঠিকাদারি আর নেতাগিরি একসঙ্গে চলতে পারে না। যে কোনও একটাকে বেছে নিতে হবে। মানা হয়েছে? ঠিকাদার ছাড়া দল চলবে? ঠিকাদাররাই তো দলের টাকা জোগান দেয়। তাঁদের বাদ দিয়ে দল চলবে? এ নিয়ে যদি কোনও এক নেতার অডিও ভাইরাল হয়? তখন দলের সেনাপতি কী বলবেন?