বরুণাংশু ঘোষ, [স্টেশন মাস্টার, পুনে, মহারাষ্ট্র, বাড়ি- যদুপুর, ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর]: গত ৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সংবাদের ওয়েবসাইট ঘাটাল ডট নেটে প্রকাশিত অতিথি সংবাদিক অভিজিৎ কাপাসের লেখা ‘সব পড়ুয়া স্কুলে ফিরে আসুক’শীর্ষকটি পড়ার পর কিছু মতামত জানানোর ইচ্ছা হলো। প্রথমেই বলি, লেখাটি সময়োপোযোগী অসাধারণ লেখা। কোভিড পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক পরিবারেই দরিদ্রতা বেড়েছে। আবার অনেক পরিবার নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। মেয়েরা বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে। এই কোভিড পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আমার নিজেরই জানা, বিগত এক বছরের অসংখ্য ঘটনার দুটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। ঘাটাল মহকুমার রাহাতপুরের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র গণেশ মণ্ডল। বয়স এগারো-বারো বছর হবে। গণেশের বাবা যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত তাই কাজ করতে পারেন না। মা দিনমজুর। ছোট ভাই রয়েছে। গণেশের স্কুল
বন্ধ। মিড-ডে মিলও বন্ধ। তাই পেটের দায়ে এবং সংসারের হাল ধরার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে সোনার কাজ করার জন্য পাড়ি দিয়েছিল চেন্নাইয়ের মাদুরাই। কিন্তু চেন্নাই রেল স্টেশনে রেলপুলিশের হাতে শিশুশ্রমিক হিসেবে ধরা পড়ে তার স্থান হল চেন্নাইয়েরই এক চাইল্ড হোমে। অনেক কষ্টে সেখান থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসার পর আবার লুকিয়ে সোনার কাজে চলে যায় সে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হল ঘাটালের যদুপুরের সরলা দোলই নামে এক কিশোরীর। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সরলা। বাবা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মা লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন। কিন্তু করোনার জন্য সেই কাজও বন্ধ। সংসার চলছিল দারিদ্র ও কঠিন জীবনের
মধ্য দিয়ে। ঠিক সেইসময় সরলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এলো সরলার মায়ের কাছে। তাও বিনা পণে। সরলমতি সরলা বাধ্য হলো বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। এরমধ্যে একবছর পার হতে না হতেই হঠাৎ দেখি সরলার কোলে এক শীর্ণ শিশু। দেখে চমকে উঠলাম। অপরিণত জননীর অপরিপুষ্ট সন্তান। এইভাবেই কত সরলা, গণেশ করোনাকালে দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে অকালে ঝরে পড়ছে তার হিসেব কেউ রাখেনি। এর হিসেব হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চেষ্টা করলেই জানতে পারবে এবং এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বেই দরকারে প্রশাসনের সহায়তায় সব শিশুদের ফিরিয়ে আনার অভিযান চালানো প্রয়োজন।
এছাড়াও ওই প্রতিবেদনে এক জায়গায় অভিজিতবাবু শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন যে, দীর্ঘ ছুটি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দক্ষতায় কোনও প্রভাব ফেলবে কিনা। শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে ‘শিক্ষাপ্রদান’ আত্মার খোরাক—অবশ্যই পেটের খোরাক নয়। অজস্র পথ ছিল বা আছে। দক্ষতার খর্ব কিসের। অনেককেই বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে কিন্তু পড়ুয়াদের ছাড়পত্র মেলেনি। কথাটি ঠিক। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়গুলিতে দূরত্ব বজায় রেখে বসার সার্বিক কাঠামো কোথায়। তাছাড়াও সরকার এখনও একশো শতাংশ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভ্যাকসিন দিয়ে উঠতে পারেননি। বড় ধ্বংস লীলার সম্মুখীন হয়ে যেতে পারি।
যাইহোক দীর্ঘ প্রায় আঠারো মাস পরে আমাদের প্রায় নতুন প্রজন্ম আবারও হাসি আনন্দে স্কুলে ফেরত যাচ্ছে। নানাবিধ উদ্যোগ নিয়ে আমরা যাতে তাদের এই ফেরাকে শিক্ষার যোগ্যতা অর্জনের জন্য অর্থবহ করে তুলতে পারি; সেটিই যেন আমাদের লক্ষ্য হয়।