প্রতিবাদী আন্দোলনে কসরত নৃত্য

দুর্গাপদ ঘাঁটি: প্রায় চার দশক মূকাভিনয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাকে বাংলায় এবং বাংলার বাইরে বারবার যেতে হয়েছে।বিশেষত রাঢ় অঞ্চলে। সেখানে গিয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করেছি সেখানকার লোকসংস্কৃতি ও তার  প্রাচীন ইতিহাস। রুক্ষ শুষ্ক জঙ্গল মহলের বহু লোক-উৎসবের মধ্যে ‘কসরত বা নাটুয়া’ নৃত্যটির কয়েকটি দিক আমাকে বিস্মিত করেছে।

তার কারণগুলি জানার পূর্বে এই এলাকার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া ভালো।মহাভারতে বর্ণিত চন্দ্রবংশ জাত রাজা বলি অার্য্যাবর্তের এক প্রবল পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর পাঁচ পুত্র-অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুম্ভ ও পুণ্ড্রের নামে তাঁর বিশাল রাজ্যকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেককে এক একটি রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে যান। এই রাজ্যগুলির মধ্যে বর্তমান রাঢ় অঞ্চলটি সুম্ভদেশের অংশ বিশেষ।

ঐতিহাসিক কানিংহোমের মতে প্রাচীন যুগে এই অঞ্চলটিকে কর্ণসুবর্ণ বলা হত। জৈন ও বৌদ্ধ যুগে এই অঞ্চলটি ‘বনভূমি’, ‘অটবি প্রদেশ’  অথবা ‘রাঢ়ভূমি’ নামে অভিহিত ছিল।সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে নাম ছিল ‘ঝাড়খণ্ড’।পরে আরও কিছু এলাকা নিয়ে বেশ কয়েকটি টুকরো টুকরো রাজ্য গঠিত হয়।সেগুলি- বিষ্ণুপুর,ঝাড়গ্রাম, ময়ূরভঞ্জ, পঞ্চকোট, মানবাজার, পাতুকম, বরাহভূম, ঝালিদা, জয়পুর, ঝরিয়া, কাতসার, নোয়াগড়, পাঁড়রা, ধলভূম,সরাইকেলা, পোড়াহাট, তামাড় ইত্যাদি।গুপ্ত যুগের পরে এই রাজ্যগুলিকে দখল করে পাল, সেন,সুলতানি ও মোগল শাসকরা।কোন কোন শাসক এখানকার উন্নতির জন্য হয়তো কিছু কিছু পরিকল্পনা নিয়ে ছিলেন তা কিন্তু পারিষদদের ললুপতায় মানুষের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে উদ্দেশ্যগুলি মাঝ পথে শুকিয়ে গ্যাছে; উল্টো দিকে দেখা গ্যাছে কর আদায়ের নামে বঞ্চিত  অধিবাসীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা চরম জায়গায় পৌঁছাতো যা ইতিহাসের পাতায় পাতায় বহু সাক্ষ্য আছে।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সরকার এই অঞ্চলটির নাম দেন ‘জঙ্গলমহল’। তার মধ্যে রয়েছে বর্তমান পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম ও মেদিনীপুরের কিছুটা অংশ।এই অঞ্চলগুলির উপর সেই গুপ্তযুগ থেকে ইংরেজ শাসন পর্যন্ত স্থানীয় কুর্মী ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য শাসকদের থাবা বসানোর চেষ্টা হয়েছে বার বার। ইতিহাসে মালভূমির সম্পদের  অধিকার কাড়তে গিয়ে প্রায় দু’হাজার বছরের মধ্যে বহুবার বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে শাসকদের সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের। তার মধ্যে  সিদু-কানহু, বিরশা মুন্ডার আন্দোলন উল্লেখযোগ্য তা অনেকেরই জানা।অথচ এই আদিম বনবাসীদের আজন্মকালের স্বাধীন ভূমি তাঁদের অধিকারে থাকা উচিৎ ছিল নির্বিবাদে।

এই অঞ্চলে আর্য গমনের পূর্বে ভারতবর্ষের প্রাচীন দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতির বসবাস ছিল তার প্রমাণ মেলে।এই দ্রাবিড় জাতির বংশধররা হলেন বর্তমান কুর্মী সম্প্রদায়। Dalton’s Ethnology of  Bengal গ্রন্থে  Dalton  লিখেছেন- “The  Kurmis settled in the western part of Manbhum.They  had been there fifty two generations.” তৎকালীন ভারতবর্ষে সাধারণত ২৫।৩০ বৎসরের মধ্যকে এক পুরুষ ধরা হতো। তাহলে উপরোক্ত মতে সময়কাল নির্ধারণ করতে যাওয়া মানে প্রাচীন ও মধ্য যুগের সন্ধিক্ষণ হবে। আর জীব-বিঞ্জানীদের গবেষণাতেও ধরা পড়েছে যে এদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের মিল আছে প্রাচীন দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে। তথাপি তাঁরাই তাঁদের সম্পদ বঞ্চিত। এখানের শাসক পাঞ্চেৎ রাজকে মুর্শিদাবাদ রাজ দরবারে বাৎসরিক খাজনা প্রদানের প্রমাণ আছে। সেটা ছিল জোর জবরদস্তিতে।আর জোর করে কেড়ে নেওয়াটাই শাসক ও শোষকের ইতিহাসের আসল চরিত্র।

যাইহোক বহু আন্দোলনের ফলে আজ থেকে প্রায় শত বছর পূর্বের বৃটিশ সরকারের প্রবর্তিত শিথিল হওয়া ‘প্রজাস্বত্ব আইন’ স্বাধীন ভারতের ১৯৫১ সালের ১লা জানুয়ারী পুনরায় বলবৎ হয়।কিন্তু ১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে ১লা নভেম্বর ছোট নাগপুরের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে চলে আসায় সেই আইন পুনরায় শিথিল হয়ে যায়।সেই সময়কালের মধ্যে ছোটনাগপুর মালভূমির মানুষের গড্ডালিকার জীবন যাত্রা ও সংস্কৃতির টুকরো টুকরো কিছু কথা কনিষ্কের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ঝাড়খণ্ড সীমান্তে’ ও ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের  ‘অারণ্যক’ উপন্যাসের মধ্যে পাওয়া যায়।এই রুক্ষ শুষ্ক রাঢ় ভূমির মানুষের  অধিকারকে নিয়ে খেলা হয়েছে বার বার।বিশিষ্ট নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের গবেষণায় এসেছে এই অঞ্চলের বঞ্চনার কথা বিশেষত ওড়িষ্যার কালাহান্ডি জেলার। তাদের বঞ্চনার সঠিক সুরাহা না হওয়ায় স্বাধীন বাংলার শাসকদের আন্দোলনে মুখে পড়তে হচ্ছে এখনও।

পশ্চিমবঙ্গের আমলাসোল,ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ী, শালবনী, লালগড়, গোয়ালতোড়, ভীমপুর, গড়বেতা, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জঙ্গল মহলের সিংহভাগ অংশ এখনও বার বার খবরের শিরোনামে এখনও উঠে আসছে।

যাইহোক এই শাল, শিমুল, মহুয়া পলাশ ঘেরা  চড়াই উতরাই লাল রুক্ষ শুষ্ক প্রাচীন জনপদের  মানুষেরা তাঁদের ভৌগলিক অবস্থান,বিশ্বাস, জীবন-জীবিকা ও শোষণ-বঞ্চনার উপর নির্ভর করে যে যে  শিল্প ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছেন তার কয়েকটির কথা উল্লেখ করছি।

এই অঞ্চলগুলিতে ভ্রমণ করতে গিয়ে যে যে সংস্কৃতির উপাদান আমার ঝুলিতে উঠে এসেছে  সেই লোক উৎসব গুলির মধ্যে শাহরুল উৎসব ,জাঁত ও মনসাপূজা,করম ও জীতুয়া,বাঁদনা বা গোবন্দনা, মকর পরব,ভগদা পরব, ছৌ নাচ, পাতা নাচ, যুগল নৃত্য বা নাচনী নাচ,ঝুমুর বা বিরহ উৎসব, ঢুয়া  সঙ্গীত, বিবাহ (বিহার) গীত, বাঁদনা বা কপিলা মঙ্গল, ভাদু ও টুসু এবং উল্লেখযোগ্য কসরত বা নাটুয়া নৃত্য।বলাবাহুল্য সভ্যতায় বিকশিত হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের জেলাগুলির উৎসব যেমন – দূর্গা ,লক্ষ্মী , কালী,জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি  যেভাবে হয় এই অনুষ্ঠানগুলি এ অঞ্চলে হত বা সেভাবে হয়না।তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন এই উৎসবগুলির বেশিরভাগই হিন্দু দেবদেবী ও বনদেবীর উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই।তবে ঐতিহাসিকদের মতানুযায়ী এই রাঢ় অঞ্চলে সংস্কৃতি চর্চা যে হারে বা যা যা বৈচিত্র্যতা নিয়ে হত ভারতবর্ষে অন্যান্য প্রদেশে সে হারে দেখা যায় না।

যাইহোক এই উপরিক্ত উৎসবগুলির মধ্যে এ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিকে যদি সঠিক পোস্ট- মর্টেম হয় তাহলে “কসরত বা নাটুয়া” নৃত্য প্রথমে স্থান পাবে ত নিশ্চিত করে বলা যায় কারণ বিনোদনের পাশাপাশি মারাত্মকভাবে দৈহিক কসরত এবং সব থেকে উল্লেখযোগ্য- স্বদেশীয়ানা ও প্রতিবাদী আন্দোলন  মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিহাস এর ধারক ও বাহক হয়ে আছে এই নৃত্য।পূর্বেই বলেছি ‘পঞ্চনাথ’ বা জঙ্গল দেশের বিকাশের লড়াইয়ের জন্য ‘কসরত ও নাটুয়া’ নৃত্যের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ শিল্পের শুরু কবে তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মত আছে।কেউ বলেছেন সেই গুপ্তযুগে, কেউ বলেছেন পাল বা সেন যুগে।তবে এটা পরিষ্কার যে এই জঙ্গলমহলের অধিকার রক্ষার্থে এই কসরত নৃত্য শুরু হয়েছিল সে নিয়ে কারো দ্বিমত নেই।

“ও মংলা-ও ডিঙলা আয় ছুটে-

ওই লালগোমরা মুখো

শযতানগুল্যা মুদের সব কাঁড়তে আঁসছে রে –

 আঁয় রে আঁয় আয় ছুটে-(দ্রিমদ্রিম ঢাকের আওয়াজ)

                      অথবা

 “ছাড়বক নাই ছাড়বক নাই মুদের ধান মুদের মান আয় ছুটে-“

এমনই বৈপ্লবিক কিছু কথাই এই নাচের প্রকৃত আবেদনকে স্বপ্রকাশিত করে।এটি একটি সুনিপুণ কসরত নৃত্য। অপরদিকে এক সুসংহত এবং সু-অনুশীলন সাপেক্ষ,নিরোগ,অটুট,অভ্যাসপুষ্ট স্বাস্থ্য  ভিন্ন এই নাচ পরিবেশন অসম্ভব। এই নাচে ঢাকের বাদ্য লাগেই; আর সঙ্গে ধামসা। সাজ-পোষাক বলতে মালকোঁচা করে আঁটোসাটো ধুতি,মাথায় কলগা,হাতে খাঁড়া ফরি, প্রায় হাত দশেক লম্বা এবং চার ইঞ্চি চওড়া রঙিন কাপড়ের টুকরো হাতে বাঁধা, বুকে লাল শালু শক্ত ও পরিপাটি করে জড়ানো।শরীর অনাবৃত,পায়ে ঘুঁঙুর গুচ্ছ। নাচ শুরুর আগে

ঢাকের গুড়ুগুড়ু আওয়াজের সঙ্গে কম্পিত পায়ের ঘুঁঙুরের শব্দ মিলিয়ে খাঁড়া ফরি সংযোগে জড়ো হস্ত কপালে ঠেকিয়ে নটরাজের উদ্দেশ্যে প্রনাম  করা প্রথম দৃশ্যে। নাচের তাল তোলার জন্য প্রথমে

সানাই বাজে তারপরে ঢাক ও ধামশা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র গুরুগর্জন আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাচ

আরম্ভ হয়।প্রথম প্রথম হাত পা নেড়ে, মুখভঙ্গি করে,চোখ ওলট পালট করে নাটুয়াকে তাল মিলাতে দেখা যায়।তার পর নাচ ধীরে ধীর চরম দিকে অগ্রসর হয়।তার পর দুই ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতো এক দিকে ঢাক আর ধামসা অন্য দিকে  নাটুয়া। কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়।এক সময় নাচ এক লোমহর্ষক দৃশ্যে পর্যবসিত হয়।যতক্ষন না বাদ্যকার অথবা নাটুয়াদের একপক্ষ ক্লান্ত হয়ে বন্ধ না করা পর্যন্ত চলতেই থাকে। উল্লেখ্য নাটুয়া এই নাচের ফাঁকে উল্টো বাজীর দ্বারা চোখের সাহায্যে মাটি থেকে ছুঁচ, সূতো খুচরো পয়সা প্রভৃতি সুক্ষ্ম ও ক্ষুদ্র জিনিস তুলে তাঁর দক্ষতার নানাভাবে কৌশল প্রদর্শন করেন। কখনও কখনও জলভর্তি মাটির ঘড়া দাঁতে চেপে তুলে গোটা নৃত্য ক্ষেত্রে ছুটতে ছুটতে ঢাকের তালে তালে নাচতে থাকেন। এই নাচে সাধারণত সংগীতের ব্যবহার হয় না।কিন্তু উপরোক্ত সংগীতের কথার মতো কিছু কখনও কখনও প্রয়োগ করতে হত। কোন বহিঃশত্রু আক্রমণ করতে এলে এলাকার মানুষকে সজাগ করার জন্য প্রথমে দ্রিম্ দ্রিম্ ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে এই গানের কথায় আহ্বানের একটি রেয়াজ যা এক প্রকার শত্রুদের আগমনের সতর্ক সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হত।যাই হোক এই নৃত্য এখন প্রত্নতত্ত্বে চলে গ্যাছে যা রাঢ় অঞ্চলের ইতিহাসকে এক সময় গর্বিত করেছে। যদি ছৌ-নাচের পাশাপাশি এই নৃত্যকে পুনরুদ্ধার করে রাঢ় অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করা যায় তাহলে ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির ইতিহাসকে যথার্থ সম্মান জানানো হবে।

   তথ্য সূত্রঃ-

১) পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের লোক-সাহিত্য -অধ্যাপক শ্রী সুভাষ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়।

২) ঝাড়খণ্ড সীমান্তে (ঐতিহাসিক উপন্যাস) -কনিস্ক।

৩) কুর্মি ক্ষত্রিয় ইতিহাস- শ্রী শিবরাম সিং।

৪) ঝাড়খণ্ডের লোক সংস্কৃতি-শ্রীরাধাগোবিন্দ মাহাত

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!