শুভম চক্রবর্তী[স্থানীয় সংবাদ•ঘাটাল]: একথা অগ্রাহ্য করা চলে না যে ‘মানুষ ইচ্ছার দাস’ কিন্তু কোনও মানুষের কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে যখন বহু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা,রক্ত-ঘাম জড়িয়ে থাকে তখন দায় অবশ্যই বর্তায় সমাজের কাছে।
কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক ভূখণ্ডের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এই ব্যাপারখানি বোঝানোর সাধ্য কার! ১৯৫১-১৯৫২’র প্রথম নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বশেষ নির্বাচন এমনকি ২০২১ সালের বিধানসভা পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে হয় নির্বাচনের ঠিক আগে না হয় পরেই বেশকিছু জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেছেন। ব্যাপারটা এমনটা নয় যে তাদের সেই পদত্যাগ দেশের ও দশের হিতের জন্য বরং প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই তাদের সেই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত মুনাফা চরিতার্থ করা। কখনও পদত্যাগের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট যে দলের প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছেন সেই দলের সাথে সম্পর্কের ভাঙন,কখনো বা নিজের দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে, ব্যক্তিগত সমস্যার কারণেও কেউ কেউ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আবার এমনও হয়েছে শুধু মাত্র উচ্চ পদে আসীন হতে চেয়ে অর্থাৎ পৌরপ্রধান থেকে বিধায়ক কিম্বা বিধায়ক থেকে সাংসদ হওয়ার তাগিদেই পদত্যাগ এর সিদ্ধান্ত।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে কোনও একজন বিধায়ক বা সংসদ বা এইধরনের কোনও জনপ্রতিনিধির মেয়াদের কার্যকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই যদি তিনি পদত্যাগ করেন তাতে সাধারণ মানুষের কী এসে যায়,এত মাথাব্যথা কিসের, কেনই বা এতো আলোচনা?
এর কারণটি লুকিয়ে আছে ভারতীয় সংবিধানে। কেন না সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী সংবিধানে উল্লেখিত কোনও জন প্রতিনিধিত্বমূলক পদ(পৌরসভা বাদে) খালি হয়ে পড়লে সর্ব্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যে যেভাবেই হোক উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই উপনির্বাচনের সমস্ত খরচই ব্যয় হয় সরকারি তহবিল থেকে। আর পরোক্ষভাবে বা প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে সাধারণ মানুষই সরকারের কোষাগার পূর্ণ করে। সোজা কথায় বলতে গেলে জনপ্রতিনিধির খামখেয়ালিপনার মাশুল গুনতে হয় জনগণকেই।
আমাদের দেশে যে পরিমাণ জনসংখ্যা সেক্ষেত্রে প্রতিটি নির্বাচনী খরচ কোটির ঘরেই ঘোরাফেরা করে। এমনকি সামান্য এলাকা নিয়ে গঠিত পৌরসভাগুলোর উপনির্বাচনের খরচও লক্ষের ঘরেই উঠেপড়ে। পরিসংখ্যান বলছে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ৬৬ হাজার কোটি টাকা। ১০০ কোটির কাছাকাছি টাকা খরচ হয়েছিল প্রতিটি নির্বাচনী ক্ষেত্রের জন্য এবং সবচেয়ে অবাক করা বিষয় প্রতিটি ভোটারের ভোটদানের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে ভোটার পিছু প্রায় ৭০০ টাকার মতো খরচ হয়েছিল। একটু পুরনো ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৯৯৯ নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে খরচ বৃদ্ধি পেতে পেতে ২০১৪ সালের নির্বাচনী খরচ হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই খরচ হয়ে যায় দ্বিগুণ। স্বাভাবিক ভাবেই অনুমান করা যাচ্ছে আগামী নির্বাচনে নির্বাচন খরচ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, ২০২১সালের নির্বাচনের ঠিক পরেই আয়োজন করতে হবে একাধিক উপনির্বাচন। কেননা এই নির্বাচন এর আগেও বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি মেয়াদ পূর্তির আগেই পদত্যাগ করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই ওইসব উপনির্বাচনগুলিতেও খরচের সংখ্যাটা যে কোথায় ঠেকতে পারে তাই সহজেই অনুমেয়।
শুধু খরচই নয় আমাদের দেশের বেশ কিছু রাজ্য আছে এমনকি বাংলাও সেই তালিকার মধ্যেই পড়ে যেখানে প্রতিটি উপ নির্বাচনের আগেই কিংবা নির্বাচনের দিন একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে,রক্ত ক্ষয় হয়েছে প্রাণহানি হয়েছে, শূন্য হয়েছে বহু মায়ের কোল। নির্বাচনের দিন এই গণ্ডগোলের ভয়েই দোকান-পাট, বাজার এমনকি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অধিকাংশ দোকানই বন্ধ থাকে, স্তব্ধ হয়ে পড়ে পরিবহণ ব্যবস্থা,নির্বাচনের আগে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ বিভিন্ন অফিসও। যে এলাকায় উপনির্বাচন হয় সেই এলাকায় সমস্ত রকমের প্রকল্প ঘোষণা বন্ধ থাকে। যার ফলে মারাত্মক হয়রানির শিকার হতে হয় খেটে খাওয়া মানুষদের। এককথায় কোনও একজন জনপ্রতিনিধির নেওয়া ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের জেরে মারাত্মক ধাক্কা খায় একটি অঞ্চলের অর্থনীতি থেকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
স্বাভাবিকভাবেই একটা অভিযোগ থেকেই যায় আর কতদিন আর কেনইবা কোনও একজন জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা বা খামখেয়ালীপনার মাশুল গুণতে হবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে? ভারতীয় সংবিধানে দলত্যাগ বিরোধী আইন থাকলেও মেয়াদপূর্তির আগে পদত্যাগ সংক্রান্ত কোনও আইনি বাধা না থাকায় এমন রীতি বেমালুম চলে আসছে।
সব চাইতে ভালো হত, দেশে যদি এমন একটি আইন থাকত, শারীরিক অসুস্থতা ছাড়া কোনও জনপ্রতিনিধি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে পদত্যাগ করেন তাহলে তাঁকে একটা মোটা টাকা আর্থিক জরিমানা দিতে হবে জরিমানা দিতে না পারলে আদালত কর্তৃক একটি শাস্তি পেতে হবে। এবং আগামী দিনে তিনি আর কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তাহলে নিজের ইচ্ছেয় জনপ্রতিনিধিরা যখন-তখন পদত্যাগ করার খামখেয়ালিপনা দেখাতে পারতেন না।
অথবা কোনও একজন ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে যদি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে সমর্থন আদায় করে সাধারণ মানুষের অনুমতিক্রমে (ভোট দানের মাধ্যমে)কোনও পদে আসীন হতে পারে, তাহলে তার সেই পদথেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্তও সাধারণ মানুষের সাথে আলোচনা করেই নেওয়া উচিত। নিদেনপক্ষে একজন জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এটুকু ভাবা উচিত তাঁর পদত্যাগের ফলে দেশের সাধারণ মানুষের আদৌ কতটা ভালো হতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এতকিছু ভাবার মতো মানসিকতার ও সময় আছে কতজনের?
আর তাই তো কবেকার আপ্তবাক্যটি আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ‘সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ!’
👆 আমাদের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলটি লাইক করুন
Home এই মুহূর্তে ব্রেকিং আইন হোক, জনপ্রতিনিধিরা ইচ্ছে খুশি, যখন-তখন পদত্যাগ করতে পারবেন না, পদত্যাগ করলে...