‘শিক্ষক বিদ্যাসাগর ও বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা’ —দেবাশিস কুইল্যা

  শিক্ষক বিদ্যাসাগর ও বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা
—দেবাশিস কুইল্যা
‘ শিক্ষক ‘ শব্দের অক্ষরগুলি বিশ্লেষণ করে পাই ; শিষ্টাচার , ক্ষমাসহিষ্ণু আর কর্তব্যপরায়ণ । এই  শব্দগুলিকে বিশ্লেষণের আলোয় ফেলে অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী ও শিক্ষক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষামূলক কাজগুলিকে বিশ্লেষিত করতে পারি ।     কোনো মহান ব্যক্তির অবদান সেই সমাজ সংস্কৃতিতে সাধারণত গড়ে উঠা ও সেই কাজগুলি অনেকাংশে প্রভাবিত হয় সেই সময়কার পারিবেশিক অবস্থা ও ঘটনাবলীর সাহায্যে ।

বিদ্যাসাগরের অভ্যুদয় ঊনবিংশ শতকে । ঊনবিংশ শতক নবজাগরণের যুগ । ভারত পথিক রামোহন ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করলেন সমাজ সংস্কার , শিক্ষা সংস্কারের মধ্যদিয়ে । নতুন ভাবনার জন্ম হল ।এই শতকের সূচনায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা,  প্রাচ্য পাশ্চাত্য ভাষা , সাহিত্য , দর্শন ইত্যাদির মেলবন্ধনে গড়ে উঠল নতুন দৃষ্টিভঙ্গি – যা সমন্বিত করল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে । ফলে মিল , বেন্থামের মতবাদ নবজাগরণে নতুন মাত্রা যোগ করল । ডিরোজিওর সমস্ত গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত সমাজভাবনা  ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব প্রতিফলিত হল মনন জগতে । ইংরাজী শিক্ষার প্রবর্তন , যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা , মানবতাবোধের বিস্তার , জীর্ণ সংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা , নারী শিক্ষার স্বল্প সূচনা , ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ , ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাভাবনা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে মূর্ত হয়ে উঠল নবজাগরণের পটভূমিতে । ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রীষষ্ঠাব্দে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ‌ যাত্রা শুরু করল রামমোহনের আদর্শ অনুসারে অতীত বর্তমান, পূর্ব পশ্চিমের ভাবনার মিলনকেন্দ্র রূপে । ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বিদ্যাসাগর এই ভাবনার যোগ্য উত্তরাধিকার রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন । ঈশ্বরচন্দ্র যে পরিবেশ ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যদিয়ে রচনা করলেন তাঁর কর্মজগৎ তা আদৌ আশাব্যঞ্জক ছিল না । সংক্ষেপে বলতে গেলে পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষ নিপীড়নের শিকার ছিল । সাধারণ জনসাধারণের জন্য শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থাই ছিল না । ফলে শিক্ষা একেবারেই একপেশে , সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ ছিল । এই ধরনের শিক্ষা স্বভাবতই প্রকৃত মানুষ তৈরীর উপযোগী ছিলনা তাই নয় সমাজ সংস্কারেরও উদ্দেশ্য ছিল না । এমন এক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর অবতীর্ণ হয়েছেন ।

ছাত্র জীবনের শেষে কর্মজীবন শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একজন হিসাবরক্ষক ও পরে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে । এই সময়ে তার অসামান্য বিদ্যাবত্তা , উদ্যম , হৃদয় ও মস্তিষ্কের কিছু বিরল  গুনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সচিব ক্যাপ্টেন জে মার্শাল , কাউন্সিল অফ্ এডুকেশনের সচিব ড: এফ জে মোয়েট এবং আরো অনেকে মোহিত হলেন । শিক্ষক বিদ্যাসাগরের আন্তরিকতা , কর্তব্যনিষ্ঠা , নিয়মানুবর্তিতা তাঁর ব্রিটিশ ছাত্র হ্যালিডে , সিটনকার , সিসিল বীডনকেও তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল করে তুলল ।

এই সময়ে বিদ্যাসাগর এইসব তরুণ সিভিলিয়নদের সংস্পর্শে এসে উপলব্ধি করলেন যে ইংরেজদের মধ্যে অনেক গুণ আছে ,যা আহরণ করা দরকার । আরও বুঝলেন , যে দেশের জনসাধারণকে  জীর্ণ কুসংস্কার ও অশিক্ষা থেকে মুক্ত করতে হলে পাশ্চাত্য ভাষা , সাহিত্য , দর্শন , বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে হবে ও জীবন চর্চায় সেগুলি প্রয়োগ করতে হবে । তাই তিনি ইংরাজী , হিন্দ শিখতে শুরু করলেন । রামমোহনের সমন্বয়ী আদর্শ অর্থাৎ প্রাচ্য পাশ্চাত্য ভাবধারার মিলনের আদর্শ তাঁকে উজ্জীবিত করল । পরবর্তী সময়ে সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ পদে বৃত হওয়ার পর প্রয়োগবাদী , উপযোগিতাবাদী ও জাত শিক্ষক বিদ্যাসাগর সমগ্ৰ শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দিলেন । তাঁর সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে প্রথমটি হল সংস্কৃত কলেজের দ্বার জাতি নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা । ১৮৫১খ্রীষ্টাব্দে শিক্ষাপরিষদের সেক্রেটারি  Captain F F C Hays কে একটি চিঠিতে লিখলেন – ” I see no objection to the admission of other castes than Brahmanas and Vaidyas or in other words, different order of Sudras , to the Sanskrit College .” সংস্কৃত কলেজে ইংরাজী শিক্ষা প্রবর্তিত হল । পাঠক্রমের অপ্রয়োজনীয় নানা অংশকে বাদ দিয়ে আধুনিক জীবনের উপযোগী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগী হলেন । পঠন পাঠনে তাঁর বক্তব্য তিনি সরকারী মহলে পেশ করেন । এই সূত্রে ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে তাঁর পত্র বিনিময় হয় । তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জাতীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য ইংরাজী শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে ছিলেন । ইংরাজী শিক্ষা বিষয়ে Council of Education এর সেক্রেটারি মোয়াটকে লিখলেন , “it is very clear that if the students of the Sanskrit College be made familiar with English literature , they will prove the best and the ablest contributiors to an enlightened Bengali literature . ”  তবে তিনি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা ব্যাবহারের কথা বারবার বলেছেন ।তিনি গতানুগতিক মুখস্থ বিদ্যার ওপর গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন । সেই স্বার্থেই শিক্ষার আত্মীকরণের জন্য সহজ করে বই লিখেছেন , পরীক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছেন । তিনি উপলব্ধি করেছেন যে উপযুক্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকলে শিক্ষাবিস্তার নিরর্থক । তাইয়১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ ই জুলাই খুললেন নর্ম্যাল স্কুল । আজকের সময়ে শিক্ষক – শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলি এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতার ফল ।

অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের ভাববিল্পবের প্রভাব বিদ্যাসাগরের  অন্যান্য প্রতিভাও ব্যাক্তিত্বের ওপরে বেন্থাম , মিল ও কোঁতর দর্শন , রুশোর মানবতার আদর্শ , দিদোর বিচারবাদের প্রভাব ক্রিয়াশীল ছিল ।    তাই সমাজ-সংস্কারের আগে তিনি শিক্ষা সংস্কারের কাজে হাত দিলেন ।শিক্ষকের দূরদর্শিতায় ভেবেছিলেন , শিক্ষার আলোতেই মানুষের বুদ্ধি ও বিচারবোধকে উন্নত করে তোলা সম্ভব ।এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের স্পষ্ট উদ্দেশ্য ধরা পড়ে তৎকালীন শিক্ষা অধিকর্তা মোয়াটকে লেখা চিঠির মাধ্যমে । তিনি লিখেছেন , ” What we require to do extend the benefit of education to the mass of the people . Let us establish Vernacular schools , let us prepare a series of Vernacular clas books on useful and instructive subjects , let us raise up a band of men qualified to undertake the responsible duty of teachers and the object is a accomplished .” এই ভাবনাকে ভিত্তি করে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । এগুলির সংখ্যা নগন্য ছিল না ।

প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও অবৈতনিক করার জন্য তাঁর উদ্যোগ কম ছিল না । সরকারী মহলে বিদ্যাসাগরের জনপ্রিয়তার দরুন তাঁর প্রচেষ্টায় প্রাথমিক স্তরে  পাঠক্রমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল । লেখা , পড়া , অঙ্ক কষা (Three Rs ) ছাড়াও পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করলেন ভূগোল , ইতিহাস , পাটীগণিত , জ্যামিতি , প্রাকৃতিক বিজ্ঞান , শারীরবিদ্যা , জীবনীগ্ৰন্থ , রাষ্ট্রনীতি । এই সব বিষয়ের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে  ছিলেন মাতৃভাষাকে ।

বয়স্ক শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান স্মরনীয় । শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব নয় । এই কথা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলেই বীরসিংহে প্রথম সান্ধ্য বিদ্যালয় খোলেন । পরবর্তীকালে কার্মাটারে সাঁওতালদের জন্য । এখনকার প্রথা-বহির্ভূত শিক্ষা ব্যাবস্থা বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টারই পুনঃপ্রবর্তন ।

রামমোহনের রায়ের সমাজ সংস্কারের পথে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষার প্রধান পুরোহিত বীরসিংহের ঈশ্বরচন্দ্র । মানবতাবাদের প্রেরণায় তিনি সমাজের দুটি অঙ্গ  – পুরুষ ও নারী, উভয়েরই শিক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য সমান উদ্যোগী ছিলেন । বহুবিবাহ , বাল্যবিবাহ , বাল্যবৈধব্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তীনি প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন । শিক্ষা প্রসারে , নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রধান শক্তি বিদ্যাসাগরকে বেথুন সহযোদ্ধা হিসেবে কাছে পেলেন । নারীশিক্ষা প্রসারের কাজে বিদ্যাসাগরের সহযোগী হলেন‌ রামগোপাল ঘোষ , দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও মদন মোহন তর্কালংকার । নারী শিক্ষার জন্য ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা Bethune সাহেবের ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু হলে ঐ বিদ্যালয় চালনার জন্য  বিদ্যাসাগরকে বেথুন স্কুলের সেক্রেটারি করে কমিটি গঠন করা হয় । বিদ্যাসাগরের নির্দেশে বেথুন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গাড়ীর সামনে লেখা হল – ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়াতি যত্নতঃ ।’ অর্থাৎ ‘ পুত্রের মত কন্যাকেও সযত্নে পালন করতে হবে ও শিক্ষা দিতে হবে । ‘

দূরদর্শি বিদ্যাসাগর শুধু নারী শিক্ষা ও বিদ্যালয় স্থাপন করেই সীমায়িত করেননি । তিনি উপলব্ধি করেছেন , শুধু বিদ্যালয় স্থাপনই যথেষ্ট নয় , শিক্ষক -শিক্ষণ প্রবর্তনও সব নয় । শিশুমনের বিকাশের ক্রম অনুযায়ী বাংলাভাষায় পরিবেশনের উপযুক্ত বই চাই । তাই ‘বর্ণপরিচয়’ লেখা । তিনি স্বরবর্ণ , ব্যঞ্জনবর্ণ , বর্ণযোজনা , শব্দ, বাক্য ও ছোট ছোট অনুচ্ছেদ , এইভাবে ক্রমধারায় সরল থেকে জটিলে , বিশেষ থেকে সাধারণে , মূর্ত থেকে বিমূর্তে  বর্ণপরিচয়কে সাজালেন ‌। সাধু ও চলিত ভাষার ব্যবহার পৃথক করলেন । অক্ষরের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করলেন । বাংলি ভাষায় বিশেষ্য, বিশেষণ , ক্রিয়া , ক্রিয়াবিশেষণ ইত্যাদির ব্যবহারকে মনস্তত্ত্বনির্ভর ভাষা-বিজ্ঞান নির্ভর করলেন শিশুমনের মতো করে । শব্দসমষ্টি দিয়ে বাক্য রচনা – যা বক্তব্যকে উপস্থাপিত করতে পারে এবং শব্দের সুললিত বিন্যাস যা বক্তব্যকে পাঠকের মনে গেঁথে দিতে পারে ৎ, সংক্ষেপে ভাষাকে মাধুর্যের সাথে ক্রিয়াশীল করতে পারে – এমন ব্যাকরণও তিনি দিলেন বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে । সরল বাংলায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যাসাগর পরিবেশন করলেন ‘কথামালা’য় । নীতিউপদেশ পরিবেশনের জন্য লিখলেন ‘আখ্যানমঞ্জরী ‘ । এইভাবে শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক , মানসিক ও নৈতিক জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে ও শিক্ষার দ্বারা সামাজিক রূপান্তরের প্রত্যাশায় তিনি সংস্কার বিবর্জিত সেক্যুলার শিক্ষার প্রথম সোপানটি দৃঢ় ভিতের উপর প্রতিষ্টা করলেন ।
শিক্ষক বিদ্যাসাগরের শিক্ষামূলক অবদান ভারতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাঁর এমন কিছু উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড আছে , যা সল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় । তাঁর অবদানের মূল্যায়ন করতে গেলে একটি কথাই মনে হয় যে আজ একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তি নির্ভর সভ্য সমাজে আরব্ধ বহু কাজ আজও বাস্তবায়িত হয়নি । বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে অবৈতনিক সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা আজও সর্বত্রগামী নয় । দারিদ্র্য , কুসংস্কার ,‌অশিক্ষা , অজ্ঞতা আজও সমাজের ব্যক্তিমানুষের পীড়ার কারণ । আজ নারীশিক্ষার অনেকখানি প্রসার ঘটলেও এখনও নারী -পুরুষ বৈষম্য সামাজিক ব্যাধি । শিক্ষার পাঠক্রম , পদ্ধতি , শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থা যেগুলির বিজ্ঞানসম্মত ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমি রচনা করেছিলেন, সেগুলির যুগোপযোগী ব্যবহারভিক্তিক পুনর্বিন্যাস এখনও কতটা হয়েছে তা ভেবে দেখার বিষয় । বাংলা ভাষার , বাংলা সাহিত্যের যে সম্ভাবনার দিকগুলির প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন , প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন , তারই উপর রচিত হয়েছে পরবর্তী সাহিত্যকীর্তি । বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে তাঁর উত্তরসূরী । তাঁর মানবতাবাদ সেক্যুলার শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী করেছিল । তাঁকে সেক্যুলার শিক্ষাভাবনার জনক বলা চলে । বিশেষ করে আজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এটির মূল্য অপরিসীম । গ্ৰামাঞ্চলে শিক্ষার প্রসার , বয়স্ক শিক্ষার আয়োজন , বৃত্তি-নির্ভর শিক্ষা , বিজ্ঞানমনস্কতা , জীবনোপযোগী শিক্ষা , মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের মধ্যদিয়ে মানুষের মনে সমাজ সচেতনতার বিকাশ বিদ্যাসাগরেরই অবদান । বাস্তববাদী , মানবপ্রেমীক বিদ্যাসাগরের ধর্ম একমাত্র মানুষের সেবা , সমাজের উত্তরণ , যার প্রধানতম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষাকে । আজও সবক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা সমান প্রাসঙ্গিক ।

এই প্রাসঙ্গিকতার আলোয় দাঁড়িয়ে আধুনিক সময়েও আজকের দিনের বিশ্লেষণ প্রয়োজন । ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার  যে বীজ রোপিত হল বিদ্যাসাগরের কর্মযজ্ঞে , আজ তা মহীরুহ । এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মত প্রনিধানযোগ্য ; – ” ….. বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত বড় জিনিসকে ছোট দেখাবার জন্য নির্মিত যন্ত্রস্বরূপ । আমাদের দেশের মধ্যে যাঁহারা খুব বড় বলিয়া আমাদের নিকট পরিচিত , ওই গ্ৰন্থ একখানি সম্মুখে ধরিবামাত্র তাঁহারা সহসা অতিমাত্র ক্ষুদ্র হইয়া পড়েন । ”

আধুনিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার যে বৃক্ষটির বীজ শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব পালনের জন্য বিদ্যাসাগর রোপন করেছেন তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের নিত্যদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হোক   শিক্ষায় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরম্পরায় ।

তথ্যসূত্র : – ১) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – সুবল চন্দ্র মিত্র।       ২) সমকালে বিদ্যাসাগর – স্বপন বসু।       ৩) অনলপ্রভ বিদ্যাসাগর – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ।        ৪) ক্রোড়পত্র – গণশক্তি পত্রিকা , ১৮ই আগষ্ট ২০১২

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!