‘১৪ই ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস’
উমাশংকর নিয়োগী[অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, নন্দনপুর হাইস্কুল, দাসপুর-১,M: 81160 68322]: আজ আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভালোবাসা দিবস’, ‘প্রেম দিবস’, ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ যে নামেই চিনি না কেন, এদিনটি কিন্তু শহিদ দিবস। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের গদাঘাতে [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]মতান্তরে তরবারির আঘাতে মুণ্ডচ্ছেদের দিন। কোনও প্রেমিকাকে ভালোবাসার জন্য তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়নি, হয়েছিল তাঁর ধর্মকে ভালোবাসার জন্য,ধর্ম প্রচারের জন্য। অবশ্য একটি অন্ধ কিশোরী জুলিয়ারের সঙ্গে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রেমকাহিনীও এর সঙ্গে জড়িত আছে , আসছি সে কথায়।
প্রাচীন রোমানরা দেবরাজ জুপিটারের স্ত্রী জুনো দেবীকে ভালোবাসার দেবী হিসেবে পুজো করত। জুনো ছিলেন খুব জনপ্রিয় ও শক্তিশালী দেবী । এই প্রেমের দেবীর সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সাম্রাজ্যে ছুটির দিন ছিল বটে, কিন্তু তাঁর জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে নয়। সেটি অন্য কাহিনী। রোমান সম্রাট হিসেবে দু’জন ক্লডিয়াসের নাম পাওয়া যায়। প্রথম ক্লডিয়াসের (৪১ খ্রিস্টাব্দ- ৫৪ খ্রিস্টাব্দ) পুত্র নিরো(৫৪ খ্রিস্টাব্দ- ৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। এই ক্লডিয়াস সম্রাটের খুব একটা সুনাম নেই। আর নিরোকে তো আমরা কম-বেশি সকলেই চিনি। মার্কাস অরেলিয়াস ক্লডিয়াস যিনি ইতিহাসে দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বা গথিকাস ক্লডিয়াস নামেও পরিচিত তিনি ২৬৮ খ্রিস্টাব্দ- ২৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোম সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। যত দিন সম্রাট ছিলেন রোম সাম্রাজ্য বিস্তারিত করার ও গথদের দমন করতে সর্বদা যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল সৈন্যরা বিয়ে করলে তাদের যুদ্ধ করার পারদর্শীতা কমে যায়। তাই রোম সৈন্যদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ করেন। কোনও সৈন্য বিয়ে করলে তার চাকরি চলে যেত। যুদ্ধে অংশগ্রহণ যুবকদের বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন । ফলে অবিবাহিত যুবক ও যুবতীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে রোমে। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হয় দেশে।
রোমের খ্রিস্ট ধর্ম যাজক মতান্তরে ইতালির আম্ব্রিয়ার টার্নি শহরের প্রাক্তন বিশপ ভ্যালেন্টাইন ক্লডিয়াসের সৈন্যেদর গোপনে যুবতীদের সঙ্গে ভালোবাসার মেলবন্ধন ঘটিয়ে বিয়ে দিতেন। অনেক সৈন্যের চাকরি চলে যেতে থাকে। গোপন সূত্রে ক্লডিয়াস জানতে পারলেন এই সব বিয়ের নেপথ্যে আছেন যাজক ভ্যালেন্টাইন, তিনিই মূল হোতা। ফলে অচিরেই ক্লডিয়াসের চোখে রাজবিদ্রোহী ভ্যালেন্টাইনকে ধরে আনা হল এবং ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারির ভোরবেলা ওই গুরতর অপরাধের জন্য মুণ্ডচ্ছেদ করা হল।
অন্য একটি কাহিনী অনুসারে- রোম সম্রাট ক্লডিয়াস গথিকাস খ্রিস্ট ধর্ম বিরোধী ছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যে বার জন দেবদেবী ছাড়া অন্য কারও আরাধনা করা চলত না। কেউ এই আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করলেই তার মৃত্যুদণ্ড অবধারিত ছিল। খ্রিস্টান যাজক ভ্যালেন্টাইন একজন সুচিকিৎকও ছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় রোমের দুরারোগ্য অসুখে ভোগা বহুমানুষ সুস্থ হয়ে উঠে। চিকিৎসা করার সময় তিনি ঈশ্বর পুত্র যিশুর কাছে প্রার্থনা করতেন, তাঁর ধর্মের কথা , যিশুর অলৌকিক ক্ষমতার কথা সকলকে শোনাতেন। এসব কথা সম্রাট ক্লডিয়াসের গোচরে এল। বন্দী করা হল ভ্যালেন্টাইনকে। বিচারের জন্য গৃহবন্দী করে রাখা হল বিচারক অ্যাস্টারিয়াসের গৃহে। ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে আলাপ করার সময় বিচারক অ্যাস্টারিয়াস ভ্যালেন্টাইনের অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পান। ভ্যালেন্টাইন তাঁকে বলেন যিশুর কাছে প্রার্থনা করলে প্রার্থিত বস্তু পাওয়া যাবেই।
অ্যাস্টারিয়াসের জুলিয়া নামে একটি অন্ধ কন্যা কারো কারো মতে দত্তক কন্যা ছিল।তিনি জুলিয়ার লেখাপড়ার ভার কিছু দিনের জন্য ভ্যালেন্টাইনের উপর ন্যস্ত করলেন। জুলিয়া ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি সব কানে শুনে ভ্যালেন্টাইনের চোখে দেখতে শুরু করলেন। একদিন বিচারক অ্যাস্টারিয়াস ভ্যালেন্টাইনের কাছে জানতে চাইলেন ,ঈশ্বরপুত্রের কাছে প্রার্থনা করলে তাঁর মেয়ের অন্ধত্ব চলে যাবে কিনা? ভ্যালেন্টাইন জানালেন তাঁদের মেয়ে জন্য ঈশ্বরের কাছে আন্তরিক প্রার্থনা করলে জুলিয়ার দেখতে পাবে । প্রার্থনা ও চিকিৎসা দুই চলতে থাকল নিয়মিত। অবশেষে জুলিয়ার একদিন দেখতে পেলেন। পৃথিবীর রঙরূপ মানস চক্ষে নয় নিজের চোখেই সব কিছু দেখতে পেলেন । অ্যাস্টারিয়াসের বিশ্বাস বেড়ে গেল ভ্যালেন্টাইনের উপর। শেষ পর্যন্ত হল কী, অ্যাস্টারিয়াস সহ বাড়ির সকলে এমন কী বাড়ির দাসদাসীরাও বাপ্টাইজ হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন। বাড়ির দেবদেবীর মূর্তিগুলি ভেঙে ফেললেন । খবর পৌঁছে গেল গথিকাস ক্লডিয়াসের কানে। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের অপরাধে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারির তাঁর গদাঘাতে মুণ্ড চূর্ণ করা হয়, অনেকে বলেন তরবারির দিয়ে মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে কারাপ্রধানের হাতে জুলিয়ারকে দেওয়ার জন্য একটি চিরকুটে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন,” From your Valentine .”
রোমের প্রক্সিদেস গির্জার পাশে ভ্যালেন্টাইনকে কবরস্থ করা হয়। জুলিয়ার সেই কবরের কাছে গোলাপি ফুলে ভরা একটি আমন্ড গাছ লাগান। তখন থেকে চিরস্থায়ী প্রেমের প্রতীক হয় গোলাপি আমন্ড। বর্তমানে যা রক্ত গোলাপে পরিবর্তিত হয়েছে। জুলিয়ার ও ভ্যালেন্টাইনের এই প্রেম কাহিনীকে অমরত্ব দিতে পোপ জেলাসিয়ুস ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ ঘোষণা করেন। সেই থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে খ্রিস্টীয় উৎসব হিসেবে পালন করা হত। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ফ্রান্সে এই উৎসব নিষিদ্ধ হয়। পরে ইংল্যান্ডের পিউরিটানরাও এই উৎসব বর্জন করে। বর্তমানে এটি কেবলমাত্র খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সর্ব ধর্মের মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইনস ডে, ভালোবাসা দিবস বা প্রেম দিবস আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হচ্ছে । কত প্রেমিক তাদের প্রেমিকার কাছে রক্ত গোলাপ উপহার পাঠায় তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের দেশের গোলাপরাও প্লেনে চড়ে বিদেশের বাজারে নিজেদের বিকোতে যায়।
ফেব্রুয়ারির মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পুরোটাই ভালোবাসার দিন উপহার পাঠানোর দিন। রোজ ডে, প্রপোজ ডে, চকোলেট ডে , টেডি ডে, প্রমিস ডে, হাগ ডে, কিস ডে এবং অবশেষে ভ্যালেন্টাইনস ডে আমাদের দেশেও এখন পালনের চলন বেড়ে গিয়েছে।