শ্রীকান্ত পাত্র: বঙ্গ রাজনীতিতে তৃণমূল ও বিজেপি নিয়ে প্রায়ই রসিকতা করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কে কীভাবে সাধারণ ছাপোষা বঙ্গবাসীর মন জয় করবে তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন দুই দলের থিঙ্ক ট্যাংক। গ্রামসির ভাষায় বলা যায় জনগণের উপর ‘ডোমিনানস’ বা আধিপত্য বিস্তার করতে চেষ্টার ত্রুটি নেই এই দুই রাজনৈতিক দলের। ইদানিং দলের গঠনগত দিক নিয়েও মনে হয় টানাটানি চলছে দুই দলে। তা না হলে লোকসভা ভিত্তিক জেলা কমিটি গঠনের দিকে ঝুঁকবে কেন তৃণমূল কংগ্রেস? ১৯৯৮ সালের জন্মলগ্ন থেকে চলে আসা দলের সাংগঠনিক চেহারা ভাঙতে গেল
কেন তৃণমূল ? বিজেপি নেতারা যদি বলে বসেন, তৃণমূল আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো ধার করে চলতে শুরু করেছে। তাহলে কিন্তু তাঁরা খুব একটা ভুল বলবেন না। দলের অন্দর মহলের খবর গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে দলের সাংগঠনিক চেহারা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন তৃণমূলের থিঙ্ক ট্যাংক। তারই চূড়ান্ত রূপ পেল সোমবার ১৬ আগস্ট। ওই দিন রাজ্যের সবকটি জেলা ভেঙে লোকসভাভিত্তিক জেলা কমিটি গঠন করেছেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। এ নিয়ে আমাদের কোনও মাথা ব্যাথা নেই। আলোচনার প্রাসঙ্গেও যাচ্ছি না। এদিনই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ভেঙে মেদিনীপুর লোকসভা
ও ঘাটাল লোকসভা জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘাটাল লোকসভা জেলা নিয়েই আমাদের আলোচনা। ঘাটাল লোকসভা জেলা কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন অমল পন্ডা। সভাপতি হয়েছেন আশিস হুতাইত। তিন গণ সংগঠন যুব তৃণমূলের দায়িত্ব পেয়েছেন দীপালি সিং, মহিলা তৃণমূলের দায়িত্ব পেয়েছেন কাবেরী চট্টোপাধ্যায় ও শ্রমিক সংগঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন বিকাশ কর। পরিষ্কার বলছি এই পাঁচ জনেরই নিজ নিজ এলাকার বাইরে তেমন কোনও পরিচিতি নেই বললেই চলে। এই পাঁচ জনের প্রোফাইল ঘাঁটলেই বোঝা যাবে এঁদের ওজন কতটা। প্রথমেই আসি ঘাটাল লোকসভার চেয়ারম্যান অমল পন্ডা প্রসঙ্গে। সবং ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অমল পন্ডা মন্ত্রী মানস ভূঁইয়ার খুবই ঘনিষ্ট বলে পরিচিত। আড়ালে আবডালে তাঁকে মানসবাবুর মানসপুত্র বলে থাকেন তৃণমূল নেতা কর্মীরা। যিনি সবঙের বাইরে কিছু জানেন না। বলা ভালো মন্ত্রী মানসের লেজ ধরে ঘুরতে ভালোবাসেন অমলবাবু। সম্ভবত মানসবাবু প্রভাব খাটিয়ে অমলকে এই পদে বসিয়েছেন । দলের অন্দর মহলের খবর এই চেয়ারম্যান বা প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ছিলেন মানসবাবুর ভাই বিকাশ ভূঁইয়ার। , ঘাটাল লোকসভায় সাতটি ব্লক যথাক্রমে ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, দাসপুর, কেশপুর, সবং, পিংলা, ও ডেবরা ব্লককে রাখা হয়েছে। ঘাটাল লোকসভা জেলা কমিটির সভাপতি (প্রেসিডেন্ট ) হয়েছেন দাসপুর-২ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি আশিস হুতাইত। যিনি একদা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ কে ম্যানেজ করে তপন দত্তকে হটিয়ে ব্লক সভাপতি হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে দলের মধ্যেই অভিযোগ, উনি নিজের অঞ্চল জোৎঘনশ্যামের বাইরে যেতে চান না। ওনার যত ভাবনা ওই জোৎঘনশ্যাম অঞ্চল নিয়েই। ওনার কাছে দাসপুর দুই নম্বর ব্লক মানেই জোৎঘনশ্যাম অঞ্চল। কানাঘুসো আরও জানা যায়, দাসপুর-২ ব্লকের ১৪ টি অঞ্চলের সভাপতিদের নাম বলতে পারবেন না আশিসবাবু। তিনি হয়েছেন ঘাটাল লোকসভা জেলার প্রেসিডেন্ট। এই আশিসবাবুর বিরুদ্ধে বিধানসভা নির্বাচনের আগে একটা মারাত্মক অভিযোগ তুলেছিলেন দলের কর্মীরা। দাসপুর বিধানসভা আসনে মমতা ভূঁইয়াকে প্রার্থী হিসাবে মেনে নিতে না পেরে নিজের একজন পেটয়া লোককে নির্দল প্রার্থী খাড়া করেছিলেন এই আশিসবাবু। বিষয়টি জানতে পেরে তড়িঘড়ি মমতা ভূঁইয়া, সুনীল ভৌমিক রা ডামেজ কন্ট্রোলে নেমেছিলেন বলে জানা যায়। তৃণমূল সূত্রে আরও জানা যায়, দাসপুর আসনে প্রার্থী হওয়ার জন্য রাজ্য দফতরে হত্যে দিয়ে পড়েছিলেন তিনি। পি কে র টিমকে উপঢৌকন দিয়েও কাজ হাসিল করতে পারেননি আশিসবাবু। বরাবরই গোষ্ঠীবাজিতে দড় আশিসবাবু তপন দত্তকে কোন ঠাসা করে রেখেছিলেন। যার ফলশ্রুতি, তপন দত্ত তৃণমূল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। একথা দলের বরিষ্ঠ নেতাদের কাছেই শোনা। এই মহামান্য নেতাই হয়েছেন ঘাটাল জেলা তৃণমূলের প্রেসিডেন্ট। চুপি চুপি আর একটা কথা বলে রাখি, আশিসবাবু সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে কবিতা আউড়ান মাঝে মাঝে। সোমবার ঘোষণার পরই ঘাটাল, দাসপুর, ডেবরা সবং, পিংলা, কেশপুরের সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতা ফোন করে বলেন, এ কী হল! উনি হয়েছেন জেলা প্রেসিডেন্ট!
এবার আসি যুব তৃণমূলের দায়িত্বে যিনি এসেছেন সেই দীপালি সিং-এর প্রসঙ্গে। ডেবরার জেলা পরিষদ সদস্য দীপালি সিং-এর পরিচিতি তাথৈবচ। উনি কবে যুব আন্দোলন করেছেন ঘাটাল দাসপুরের যুব ব্লক তৃণমূল সভাপতিরা বলতে পারেননি। এমনকি নব মনোনীত জেলা প্রেসিডেন্ট আশিস হুতাইতও জানেন কী না সন্দেহ। মহিলা তৃণমূলের জেলা সভানেত্রী হয়েছেন গড়বেতার কাবেরী চট্টোপাধ্যায়। উপযুক্ত মহিলা তৃণমূল নেত্রী না থাকায় গড়বেতা থেকে ধার করে আনা হয়েছে কাবেরীদেবীকে। এটা ঠিকই তিনি ভালো বক্তা। ভালো সংগঠক। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির গেরুয়া পতাকা হাতে নিয়েছিলেন তিনি। তারপর ডিগবাজি (যা রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন) খেয়ে ঘাসফুলে পা ঘষে ঘষে ফিরে এসেছেন। সংবাদ মাধ্যমের কাছে তাঁর স্বীকারোক্তি, আমি আবার কবে বিজেপিতে গেলাম। আমি তো বরাবরই তৃণমূলের একনিষ্ট কর্মী। ইনি হয়েছেন জেলার মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী। সবশেষে আসি ‘শ্রমিক নেতা’ বিকাশ কর প্রসঙ্গে। বিকাশবাবু ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ। তৃণমূলের শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ঘাটাল ব্লক তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদকও বটে। আমার সাংবাদিক জীবনে তাঁকে কখনোই শ্রমিক আন্দোলন করতে দেখিনি। শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে কখনই সরব হতে দেখা যায়নি তাঁকে। স্বচ্ছ সুবক্তা বিকাশ এই দায়িত্ব না নিলেই নিতে পারতেন। হ্যাঁ, আশিসবাবু এবার তাঁর পছন্দের লোকজন নিয়ে জেলা কমিটি, ব্লক কমিটি গড়বেন। এই টিমই আগামী লোকসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করবে। তখনই বোঝা যাবে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা কতখানি।