মন্দিরা মাজি, ‘স্থানীয় সংবাদ’ ঘাটাল: মা বলতে আমরা যা বুঝি, তা হল স্নেহ, ভালবাসা ও মমতায় ভরা একটা নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু মায়ের এই নির্মমতার ছবি সবার কাছে সত্যিই খুব অচেনা। ১৫ বছর আগে নিজের সন্তানকে ফেলে চলে যাওয়া সেই মা’কে ঠিক কী অ্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে তা আমাদের জানা নেই। যেই বয়সে মায়ের কোলে, বাবার ছত্রছায়ায় ও পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে হেসে-খেলে দিন কাটানোর কথা, সেইসময় হোমের একটি ছোট ঘরে বসে দিন যাপন করতে হয়েছে চন্দ্রকোণার বারিন্দার ঘোষাল পরিবারের
সেই ছোট্ট মেয়েটিকে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আমরা বলছি সোহিনীর কথা। যার একটি প্রতিবেদন আমাদের ডিজিটাল মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়েছিল। পরিবার-পরিজন হারা সেই মেয়েটিকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিল জয়গুরু সেবাঞ্জলি সেবা সমিতি।
২০০৭ সালে স্বামীর সাথে বনিবনা না-হওয়ায় দু’বছরের কন্যাকে নিয়ে স্বামী গোবিন্দ ঘোষালের বাড়ি ছেড়ে ছিলেন মধুমিতাদেবী। স্বামী সহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে পুলিশি হেফাজতে রেখে হেনস্থাও করিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। ছোট্ট সেই কন্যা সন্তানকে নিয়ে মেদিনীপুর শহরের একটি ভাড়া
বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানে কিছু দিন থাকার পর নার্সিং প্রশিক্ষণের অজুহাতে মেয়েকে ভাড়ায় থাকা প্রতিবেশীর বাড়িতে রেখে ‘উধাও’ হয়ে যান। কিন্তু দীর্ঘ দিন না ফেরায় সেই পরিবার বাধ্য হয়ে পুলিশ ও চাইল্ডলাইনের শরণাপন্ন হয়। পরে পুলিশ ও চাইল্ডলাইনের ব্যবস্থাপনায় সোহিনীর ঠাঁই হয় হোমে। সোহিনীর নাম, তাঁর মা ও বাবার নাম এবং চন্দ্রকোণা এলাকার বাসিন্দা —এই গুটি কয়েক তথ্য ছাড়া ওই প্রতিবেশী যেহেতু আর কিছুই জানতেন না তাই তাঁরা পুলিশ ও চাইল্ডলাইনকে তার বাইরে কোনও তথ্য দিতে পারেননি। হোমে সোহিনী সম্বন্ধে ওই গুটিকয়েক তথ্যই ছিল।
সেই থেকে হোমেই দিন কাটতে থাকে সোহিনীর। পরিজনদের কাছ থেকে দূরে থেকে একদমই যে ভালো নেই সোহিনী তা প্রথম অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলেন হোম পরিদর্শনে আসা জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক সন্দীপকুমার দাস। সোহিনীর সঙ্গে তিনি বার বার কথা বলেন। তার খেদ-অভিমান মিশ্রিত কথা সন্দীপবাবুকে খুব ব্যথিত করে তোলে। হোম সূত্রে জানা গিয়েছে, বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে সন্দীপবাবু সোহিনীর ঠিকানা খুঁজে বার করার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন। সন্দীপবাবু বার বার হোম কর্মীদের সামনে বলতেন, সোহিনীকে আমি বাড়ি ফিরিয়েই ছাড়ব, এটাই আমার চ্যালেঞ্জ। কিন্তু হোমে সোহিনীর বাবার নাম এবং চন্দ্রকোণা এলাকা ছাড়া আর কোনও তথ্যই ছিল না। এদিকে সন্দীপবাবু হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তাই সোহিনীর ঠিকানা খুঁজে বার করার জন্য তিনি রামজীবনপুরের জয়গুরু সেবাঞ্জলি সেবা সমিতির সহায়তা নিলেন। শিশু সুরক্ষা অফিসারের দেওয়া নাম, ঠিকানা ধরে জয়গুরু সেবাঞ্জলি সেবা সমিতির সম্পাদক প্রশান্তকুমার ঘোষ ও তাঁর সহকর্মীরা সোহিনীর ঠিকানা খোঁজার কাজ শুরু করেন। চন্দ্রকোণা-২ ব্লকের ভোটার তালিকা ধরে সন্ধান চালানো হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সোহিনীর বাবা গোবিন্দ ঘোষালের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি সম্পূর্ণ ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন। প্রশান্তবাবু সোহিনীর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানান জেলার শিশু সুরক্ষা অফিসার, অতিরিক্ত জেলা শাসককে এবং ১২ নভেম্বর চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সাথে যোগাযোগ করেন। সমস্ত সরকারি নিয়ম মেনে ১৬ নভেম্বর অসহায় সেই পিতা ও পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের কন্যাকে। সোহিনী জানিয়েছে, সে মায়ের কাছে ফিরতে চায় না কখনই। তার কাছে তার বাবা’ই হল মা আর বাবা। হোম থেকে ভিডিও কলের মাধ্যমে বাবাকে দেখিয়েছিল। ১৬ নভেম্বর বাবা জেঠু মিলে তাকে হোম থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। বাড়ির মেয়েকে দীর্ঘ ১৬ বছর পর ফিরে পেয়ে খুশি পরিবারের লোকজনেরাও।