তৃপ্তি পাল কর্মকার: উৎকট এবং উগ্র সাজগোজ বর্তমান প্রজন্মের মেয়েদের বেশি পছন্দের। পরিবেশের সঙ্গে মানানসই হোক বা না হোক, স্কিনের কতটা ক্ষতি হল, না হল এসবের মাথায় তুঁড়ি মেরে উগ্র সাজগোজের দিকেই ঝোঁক বাড়ছে নারী জাতির। তবে সবাইকে এই দলে ফেলা ঠিক নয়। হালকা কাজল প্রসাধনীতে আটকে যাওয়া মেয়েরা হয়তো ভাবেন বুঝি বা পারলাম না এই যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে। কিন্তু তারাই অজান্তে বাঙালির চিরায়ত সাজগোজের ঘরানার পরম্পরা ধরে রেখেছেন। এক প্রজন্ম আগেও নারীজাতি হালকা লিপস্টিক আর কাজলের মধ্যে দিয়েই তাদের প্রসাধনী সেরে নিত। এতে তাদের বয়সের স্বাভাবিক লাবণ্যও ছলকে পড়ত। কোথাও বয়স লুকোতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা ছিল না। বলা ভালো, সে প্রয়োজনীয়তা তখনকার মেয়েরা অনুভব করেননি।
আজকে ঘষাফোনে বিভোর বালিকা থেকে বুড়ি। কী প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে সব! বয়স লুকিয়ে উৎকট সাজতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই সব ছবি আপলোড করতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ঘনঘন পাল্টাতে হবে প্রোফাইল পিকচার। লাইক পড়বে, শেয়ার হবে এবং সর্বোপরি পুরুষ জাতির হৃদয়ে হিল্লোল তুলে প্রমাণ করতে হবে রূপে আমার কাছে হার মানে বহু উর্বশী, অপ্সরা।
বলিহারি সব মেকআপ বেরিয়েছে এখন। ঠোঁটের রং কখনও কালো খয়ের তো কখনও আসমানি, কখনও ডিপ নীল তো কখনও রক্ত খাওয়া রূপকথার রাক্ষসী! উৎকট সাজগোজের এই মেয়েগুলোকে দেখলে মনে হয় এরা কি এলিয়েন না সত্যি এই গ্রহের বাসিন্দা!
কেন এরা বয়সের স্বাভাবিক লাবণ্য লুকিয়ে উৎকট সাজগোজের দিকে ঝুঁকেছে? কেনই বা বিউটি অ্যাপের সাহায্য নিয়ে ফটো এডিট করে পোষ্ট করে?
মনোবিদরা মনে করেন, গভীর মানসিক অবসাদের শিকার এই সব মেয়েরা। প্রত্যেকেই নিজেকে জাহির করতে চায়। এই সব মহিলাদের অন্যান্য ফিল্ডে নিজেদের বিকশিত করার ক্ষমতা থাকে না বলেই তাঁরা ফেসবুকে দু’চারটা লাইক-কমেন্ট পাওয়ার জন্য নিজের বিভিন্ন পোজের ছবি পোস্ট করার পরিকল্পনায় থাকে। এই মেয়েরা মনে করে রূপ গেলেই এদের সব চলে গেল। হাতে সেভাবে কাজকর্ম থাকে না। প্রচুর সময় হাতে পায় বলেই ইচ্ছে করেই এরা অবসাদ তৈরি করে। এই অবস্থা কেউ নিজে থেকে না কাটালে জোর করে তাকে বার করা সম্ভব নয়। এরা নিজেরা তো অবসাদে ভুগতে থাকে, সেই সঙ্গে প্রিয়জনদেরও অবসাদে ফেলে। অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও জোর করে রূপের প্রশংসা করতে বাধ্য করে এরা।
মনোবিজ্ঞানীরা আরও বলেন, ফেসবুকের নেশায় বুঁদ হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। ক্ষুধামন্দা, মানসিক বৈকল্য, বিষণ্ণতা ও শারীরিক অক্ষমতা তৈরি হচ্ছে তাদের মধ্যে। ফলে কোমলমতি এসব মেয়েদের মনোযোগ কমে যাচ্ছে, কমছে পাঠাভ্যাস, সেই সঙ্গে সামাজিক সৌজন্যতাবোধও। খিটখিটে মেজাজ, হিংস্রতা, চোখের অসুখ, নার্ভের সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাদের। মানসিক ভারসাম্যহীনতার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ফেসবুকচারী এই প্রজন্ম।
এটা তো সত্যি কথাই যে, হাতে প্রচুর কাজ থাকলে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাওয়া যায় না। সময় যাদের বাড়তি তারাই অকাজে মন দেয়। আজকের দিনে ‘নেই কাজ’ মানেই অবসাদ। অবসাদ মানেই যে রাস্তা ঘাটে ছুটে পালাবে, উস্কোখুস্কো চুলে ঘুরে বেড়াবে তা কিন্তু নয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবসাদের সংজ্ঞাটা পাল্টেছে। মোটামুটিভাবে আপনিও বুঝতে পারবেন যে, কে গভীর অবসাদে ভুগছে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৯০ শতাংশ মেয়েরাই অবসাদের শিকার।
যাদের আকর্ষণের জন্য মূলত এই ছবি পোস্টের দৈনন্দিন কর্মসূচি, সেই পুরুষেরা কিন্তু এই ছবি পোস্টটা ভালো চোখে দেখে না। কতকটা ব্যঙ্গ করেই ‘হাই, হুই, কিউটি, বিউটি’ মন্তব্য করে থাকে। অনেকে তো বন্ধু মহলে ওই সমস্ত মহিলাদের ‘ছেলে ধরা’ বলেও মন্তব্য করে।
মোটামুটিভাবে অবসাদ কেমন করে বুঝব? আজকের দিনে আমরা তো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামকে অস্বীকার করতে পারি না। ফেসবুকেই যাওয়া যাক। ফেসবুকে এবেলা-ওবেলা নিজের মুখের ঘনঘন ছবি পোষ্ট দেখলেই বুঝতে হবে লাইক চায়, শেয়ার চায় আর ঘনঘন খুলে দেখে কটা কমেন্ট পড়ল, কটা শেয়ার হল। এদের অন্য কোনও কাজে মন নেই। থাকতে পারে না। ঘষাফোনে বন্দি এদের ভার্চুয়াল জীবন। ভার্চুয়াল জীবনে বন্দিনীদের বাহ্যিকভাবে কালাকাল জ্ঞান লোপ পায় বলে পরিবারের সদস্যরাও সামান্য পরিষেবা আশা করতে পারে না। আর বাস্তব কথা, যাদের আকর্ষণের জন্য মূলত এই ছবি পোস্টের দৈনন্দিন কর্মসূচি, সেই পুরুষেরা কিন্তু এই ছবি পোস্টটা ভালো চোখে দেখে না। কতকটা ব্যঙ্গ করেই ‘হাই, হুই, কিউটি, বিউটি’ মন্তব্য করে থাকে। অনেকে তো বন্ধু মহলে ওই সমস্ত মহিলাদের ‘ছেলে ধরা’ বলেও মন্তব্য করে।
আজকের অধিকাংশ মেয়েদের মনের অসুখের কারণ একটাই যে এনগেজমেন্ট নেই। যে সব মেয়েদের দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতে হয় তাদের কিন্তু অবসাদ নেই। প্রচুর অবসর মানেই প্রচুর অবসাদ। অবসাদের আর দোষ কী? কেউ যদি তাকে ইচ্ছে করে ডেকে আনে? অবসাদের বড়ো কারণ এই ঘষাফোনের অপব্যবহার। ঘষাফোনের হাত ধরে এসেছে ভার্চুয়াল জগত, কৃত্রিম প্রতিযোগিতা। কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত কম-বেশি সবাই তো এই ভার্চুয়াল জগতে আসক্ত! বেশিরভাগই ঘষাফোন ব্যবহার করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করবে বলে। ঘষাফোনের যে বহুমুখী ব্যবহার আছে সে সব জানার দরকার নেই, খালি বিউটিঅ্যাপটা ঠিকঠাক থাকলেই হল।
যাইহোক, পুরুষের ঘাড়ে সংসারের মূল দায়িত্ব বলে তাদের অবসাদ কম, দায়িত্ব বেশি। এই অবসাদ থেকে মুক্তির উপায় তবে কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। পরিজনদের উচিত যারা অতিরিক্ত ভার্চুয়াল জগতে মগ্ন থাকে তাদের সুকৌশলে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে দেওয়া, যাতে ঘষাফোনের ভার্চুয়াল জগতে কম যেতে পারে।