দুর্গাপদ ঘাঁটি:‘History’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Historia’ থেকে এসেছে। যার অর্থ অনুসন্ধান, গবেষণা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে অনুসন্ধান করা। কিন্তু নিরপেক্ষতার একটি চরম দিক ইতিহাসকে আয়নার মত সত্যে উদ্ভাসিত করা এক কাজ, আর নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে তথ্য বিকৃত করে প্রকৃত সত্যকে ভবিষ্যতের আয়নায় জনমানসে পৌঁছাতে না দেওয়া এক চরম অপরাধ। এভাবে যুগে যুগে অনেক সত্যকে চাপা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘History repeats itself’ প্রকৃত ইতিহাস ফিরে ফিরে আসেই। তেমনি চেঁচুয়ার হাট এবং পলাশপাই খালের যেসব ইতিহাস চাপা পড়ে গিয়েছে তা ধীরে ধীরে উদঘাটিত হবেই।
মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন চেঁচুয়ার হাট বাংলার শিল্প, সাহিত্য, কৃষি, শিক্ষা, বাণিজ্য ও দুর্বার আন্দোলনে প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমান যে সব শহরগুলো গড়ে উঠেছে এবং বাণিজ্য, শিক্ষায়, সভ্যতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে পূর্বে কিন্তু অনেক অনেক হাট-বাজার সেই ভূমিকা পালন করতো। চেঁচুয়ার হাট তার অন্যতম। প্রায় ৩০০ বছরের লিখিত তথ্য মিললেও প্রকৃতপক্ষে এই হাট আরও প্রাচীন তার অনেক অলিখিত প্রমাণ আছে। বর্তমানে হাটটি যে স্থানে অবস্থান তা কিন্তু আনুমানিক ১২০০ বছর পূর্বে যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের ঢেউ বাংলায় আছড়ে পড়েছিল তখন হাটটি বসতো বর্তমান অবস্থান থেকে কিছুটা উত্তর পশ্চিমে কাঁসাই নদীর তীরে। এই হাট সংলগ্ন নদী ঘাটটির সঙ্গে তৎকালীন তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে নদী পথে পরিবহণ, প্রচার ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক চলত। পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্যাপক আখ চাষ হওয়ার কারণে দাসপুর থানা ব্যাপী কয়েক’শ আখমাড়াই কল গড়ে উঠেছিল। আর এখান থেকে নদী পথে উৎপাদিত গুড় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি হত, সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে বিড়ি ও সব্জি এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যও।
আরও এক গর্বের মেদিনীপুর জেলার প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন রথের মেলাটি হল গোবিন্দ নগর গ্রামের চেঁচুয়ার হাটে রথের মেলা। যা ঘাটাল তথা মেদিনীপুরের সভ্যতা, সংস্কৃতি বিকাশ ও চর্চার পথিকৃত হয়ে আছে।
আরও এক ইতিহাস-পরাধীন ভারতবর্ষের নীল বিদ্রোহের। প্রথম দিকে ভারতবর্ষের নীল চাষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার ছিল। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সনদ আইনের ফলে তাদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায়। ফলে ব্রিটেন থেকে দলে দলে বনিক ভারতবর্ষে আসেন নীল চাষ করিয়ে মুনাফা লুটতে । ফলে চাষের জন্য জমি প্রয়োজন। তাই ভারতীয় কৃষকদের ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় জোরপূর্বক দাদন প্রদান করে নীল চাষ করাতে বাধ্য করাতেন। তাই বাংলার অন্যান্য অংশের মতোই চেঁচুয়া হাট সংলগ্ন কৃষককেরাও বাধ্য হয়েছিলেন নীল চাষ করতে। এর ফলে হাট সংলগ্ন বসন্তপুর, জালালপুর ও গৌরাতে রেশম নীলকুটিরও স্থাপিত হয়েছিল। ১৮৫৯ সালে বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরে এক প্রতিবাদী নীল চাষি হাজি মোল্লা প্রথম প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি বলেছিলেন নীল চাষ অপেক্ষা ভিক্ষা করা শ্রেয়। তার পর দিক বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে নীল চাষ বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ঢেউ চেঁচুয়া হাট ও তার সংলগ্ন এলাকাতেও পড়ে।
এথেকে বোঝা যায় ১৯৩০এ চেঁচুয়া হাটের স্বদেশী আন্দোলনের আগেও এখানে এমন প্রতিবাদের সংগ্রামী মাটি তৈরি হয়েগিয়েছিল।
এবার আলোচ্য পলাশপাই খাল। ভারতের আরও এক বৃহত্তর স্বাধীনতা আন্দোলনের বুড়িবালাম! মেদিনীপুরের ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল নাম। পরতে-পরতে ইতিহাস। এই খালের নাম বাদ দিলে মেদিনীপুর জেলার সভ্যতা ও তাম্রলিপ্ত বন্দরের সঙ্গে প্রাচীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক, সর্বোপরি মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বৃহত্তম ইতিহাসের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ খালটি যে অতি প্রাচীন তা সম্প্রতি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের পরিকল্পনা মাফিক সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ায় প্রায় হাজার বছর পূর্বের প্রাচীন আদলে তৈরি এক বিশালাকার নৌকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। যখন নাব্যতা ছিল এই খাল পথে শ্যামগঞ্জ হয়ে রূপনারায়ণ নদের মাধ্যমে যোগাযোগ ও মালপত্র পরিবহনের কাজ চলত।
ব্রিটিশ শাসনকালে দাসপুর থানার রাস্তাগুলি কোনও পরিকল্পনা মাফিক না হওয়ায় এবং বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ থাকায় ব্রিটিশ শাসক ও অাধিকারিকরা এই খালের মাধ্যমে যাতায়াত করতেন। তাঁদের নির্মিত আজুড়িয়া ও দুঃশাসপুর ডাকবাংলোগুলি পলাশপাই খাল ও কাঁসাই নদীর তীরে। তাঁরা কোলাঘাট থেকে এই খালের মধ্য দিয়ে বজরায় এই বাংলোতে আসতেন ও তাঁদের প্রশাসনিক কাজকর্ম ও বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতেন।
যাই হোক পলাশপাই খালকে ভারতের আর এক বৃহত্তম ইতিহাসের বুড়ি-বালাম বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। কয়েকটি ইতিহাস টানলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। ১৯৩০ সালের ৩ জুন ও ৬ জুন চেঁচুয়ার হাটের উত্তর পূর্ব দিকে এই পলাশপাই খালে ও এর দুই দিকে বাঁধ বরাবর যে ইতিহাস ঘটে গিয়েছে তা ভারতবর্ষের ইতিহাসকে গর্বিত করেছে। এই খালের তীরেই ইংরেজ সিপাহিদের গুলিতে ১৪ জন বীর সংগ্রামী শহিদ হয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিশ্বাস ঘাতকদের সংখ্যাও তো কম ছিলো না! স্বদেশীদের গোপন অাস্তানা চককিশোর, শ্যামগঞ্জ, চেঁচুয়া হাট ও তেমুহানী ঘাটের আন্দোলনের সমস্ত খবর তৎকালীন দাসপুর থানার মধ্যে বেশ কিছু ব্যাবসায়ী গোপনে ব্রিটিশ পুলিশের কাছে পাঠাত। আর তাই পুলিশ যখন পৌঁছত, তৎক্ষণাৎ স্বদেশীরা এই মেদিনীপুর জেলার বুড়ি-বালাম অর্থাৎ পলাশপাই খালের তীরে ঝোপঝাড়ের মধ্যে আশ্রয় নিতেন। এই খাল তাঁদের মাতৃস্নেহে রক্ষা করত কিন্তু বিশ্বাসঘাতকরা সেখানেও তাঁদের বিশ্রী হাতটাও গলিয়ে ছাড়ত। এভাবে তাঁদের ষড়যন্ত্রে বেশ কয়েকবার স্বদেশীরা গ্রেফতারও হয়েছিলেন। এমন অনেক চাঞ্চল্যকর ইতিহাস লুকিয়ে আছে সেগুলি ধীরে ধীরে এক দিন প্রকাশ পাবেই।
•প্রাবন্ধিক পরিচিতি: ঘাটাল মহকুমা নাট্য ও মূকাভিনয় আকাদেমির সম্পাদক। বাড়ি দাসপুর থানার গৌরা গোবিন্দনগরে। মো: ৯৪৩৪৬৬৪০৪৪