দেবাশিস কুইল্যা:সর্বোপরি তিনি একজন সফল মানুষ। নিজের ধর্মীয় অনুশাসনে গভীর বিশ্বাসী। তিনি নামাজ পাঠ করেন। আবার তিনিই হিন্দু ধর্মের রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্য লীলা, মঙ্গল কাব্যের কাহিনীও আত্মস্থ করেন গভীর চেতনায়। ধর্মীয় ভাবাবেগের চেতনায় গভীর বিশ্বাসে বলে দিতে পারেন আধ্যাত্মিক চেতন-মার্গের পথ ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা। এই দুইয়ের একত্রিত পথে সৃষ্টির রূপ ধরা যায় বিভিন্ন আঙ্গিকে, কাঠামোয় আর চেতনার নৈসর্গিক আল্পনায়। এখানেই সৃজনশীল মন সৃষ্টির রূপকল্পকে উত্তীর্ণ করে মনুষ্যত্বে। তাই সমস্ত সংকীর্ণতার বেড়া পার হয়ে তিনি একাকার করে দিতে পারেন ধর্মীয় সীমানা; যেমন পরিযায়ী পাখি জানে না কাঁটাতারের সীমানা। তাই তিনি ভক্তি সহকারে হিন্দুর ঠাকুরের ছবি আঁকেন আবার মাজারেও যান।
দাসপুর থানার নাড়াজোলের বাসিন্দা ইসমাইল চিত্রকর। তিনি ও তার পরিবার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু জীবিকা নির্বাহ করেন পূর্বপুরুষ সূত্রে অর্জিত পেশার উপর নির্ভর করে। তিনি ছবি আঁকেন। রং তুলিতে বাঙ্ময় করে তুলেন বিভিন্ন ধর্মীয় কাহিনী ও গল্প। তিনি যেমন নিজের ধর্মের সত্যপীর সাহেবের গান বাঁধেন তেমনি রামায়ণ, মহাভারত, নিমাই সন্ন্যাস, চৈতন্যলীলা ও মঙ্গল কাব্যের কাহিনীর সুর তোলেন। এ যেন রাজ আনুগত্যের শপথ ও দায়। হয়তো বা তাই।
সদগোপজাতীয় উদয়নারায়ণ ঘোষ খ্রিষ্টীয় ষোল শতকে নিজ আধিপত্য বিস্তার করে নাড়াজোলে রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করলে পরবর্তী সময়ে চুনিলাল খান অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে রাজবাড়ি, হাওয়া মহল, শিব মন্দির, দুর্গা মন্দির, পঞ্চরত্নের মন্দির, আটচালা প্রভৃতির নক্সা রং করতে ও তাদের সোন্দর্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বীরভূম থেকে ইসমাইল চিত্রকরের পূর্ব পুরুষদের নিয়ে আসেন নাড়াজোলে। রাজা চুনীলাল খান নিজের এলাকায় জায়গা দিয়ে বসবাসের ব্যাবস্থা করে দেন। সেই সময় থেকে এই বংশের সদস্যরা রাজ অনুগ্ৰহ পেয়ে আসছে। সময়ের প্রেক্ষিতে নিয়মের পরিবর্তনে রাজ অনুগ্ৰহ বন্ধ হলেও এই চিত্রকর পরিবারের রাজানুগত্য রয়েই গেছে। এখনও তার অন্যথা হয়নি। তাই ইসমাইলবাবু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা রাজবাড়ির দুর্গাপূজোর বিসর্জনের ও রাম নবমীর রথের মেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
বর্তমান সময়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য ইসমাইলবাবু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পূর্বপুরুষদের বংশানুক্রমিকভাবে শেখা কাজের উপর নির্ভর করতে হয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যরা সচেতনভাবেই ভক্তি সহকারে গড়েন দুর্গা, লক্ষী, কালী, কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী, মনসা প্রতিমা। আবার ছাঁচে তৈরি প্রতিমা বাজারে বিক্রিও করেন। ইসমাইলবাবু শুধু একা নন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যরা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন যখন তাঁদের তৈরি প্রতিমা পুজো হওয়ার সময় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন।
এই চিত্রকর পরিবারের তৈরি প্রতিমা যত না বাজার মূল্য পেয়েছে তার থেকেও অনেক বেশি সমাদৃত পটচিত্রের কাহিনী। শুধু বাংলার বা ভারতের নয়, পটশিল্পের গবেষকেরা এসেছেন সুদূর জাপান ও চীন থেকে। শুনেছেন ইসমাইলবাবুর পটের গান ও সংগ্ৰহ করেছেন পটচিত্র। গবেষকরা আবার অনুভব করতে চেয়েছেন ধর্মীয় অনুভূতিতে একত্রিকরণের সুর।
প্রতিমার জন্য বাজারের রাসায়নিক রং ব্যবহার করলেও পটের জন্য অনুসরণ করেন প্রাকৃতিক রং। তার জন্য পাকা পুঁই মেজরি, শণ, ঝিঙে, সজনে ফুল, সীম বীচ, খিরিশ গাছের শুকনো ডালের পোকা প্রভৃতি উপকরণ।
এখন থেকেই জীবিকার জন্য ইসমাইলবাবুর দেখানো পথই অনুসরণ করছে তাঁর পুত্র ও দৌহিত্র। পূর্বপূরুষের দেখানো পথেই তারা অনুগামী। যাদের পূর্ব পুরুষেরা এসেছিল জীবন জীবিকার তাগিদে, তারাই বিধিবদ্ধ সমাজের বাইরে থেকেও এইসব মানুষের বসবাস, স্থানীয় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। শিল্পের আঙ্গিকে, পটচিত্রের গীতিকথায় ও তাদের বাঁধাগানে যে গভীর ভাব-ব্যাজ্ঞনার ইঙ্গিত মেলে, তা বিশিষ্ট মর্যাদা দান করেছে। এই বিশিষ্টতার ধারক ইসমাইলবাবু ও তাঁর পরিবার। •ছবিটি ইসমাইল চিত্রকরের।