‘আমি কি ভুলতে পারি’ —দেবাশিস কুইল্যা
একুশে ফেব্রুয়ারি । রক্তের অক্ষরে লেখা উজ্জীবনের দিন । সোনার অক্ষরে ও । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে থেকে মেডিকেল কলেজের পথ । বিন্দু বিন্দু রক্তের আল্পনায় লেখা বরকত – সালাম – রফিক – জব্বার । কোনদিন মুছবে না এই রক্তের দাগ । মৃত্যুর বুকের মধ্যেও এক আলো লুকানো থাকে । ধ্বংসস্তূপে এত প্রান ! অনন্ত শয়ানেও জীবন জেগে থাকে আত্মোপলব্ধির নিবিড় মাধুর্য নিয়ে । সাংবাদিক আব্দুল গফ্ফর চৌধুরী সেদিন সন্ধ্যায় মেডিকেল কলেজের রক্তাক্ত ছাত্রদের বেডের পাশে বসে একটুকরো ছেঁড়া কাগজের ওপর লিখেছিলে— ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরানো এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলতে পারি
আমার সোনার ছেলের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলতে পারি?’
এ কবিতার কথায় সুর দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ । এ শুধু গান নয় , ছন্দের বিস্তার নয় , সুরের উচ্চারণ নয় । এ একটি জাতির বিশ্বাস – বেদনা , আনন্দ- অহংকার , আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিবাদের প্রতীক । মন্ত্রের মত এর অমোঘ উচ্চারণ ্য, প্রত্যয় দৃঢ় , অঙ্গীকারে দৃপ্ত । এ কবিতার চরণে
চরণে ঝঙ্কার তোলে আমাদের ব্যথিত হৃৎপিণ্ডের ক্রমিক স্পন্দন , আমাদের চৈতন্যের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে পাখি-ডাকা ভোরের শিহরিত জাগরণ । আজ এ গান ইতিহাস – গর্বের , আদরের, আত্মানুসন্ধানের ও আত্ম আবিষ্কারের । একুশের রক্তসিঞ্চিত স্মৃতি বুকের মধ্যে কালবৈশাখীর ঝড় তুলেছিল বলেই তো শামসুর রাহমান সব অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করে হাহাকার করতে পেরেছিলেন “বর্ণমালা , আমার দুঃখিনী বর্ণমালায় “-
‘হে আমার আঁখিতারা , তুমি উন্মিলিত সর্বক্ষণ জাগরণে
তোমাকে উপড়ে নিলে , বলো তবে কি থাকে আমার?’
একুশে ফেব্রুয়ারি উচ্চারিত হলে আমার বুকের মধ্যে কে যেন দুন্দুভি আর দামামা বাজায় , বর্শার অনাবৃত ফলক দিয়ে টকটকে রাঙা সূর্যের বুকটাকে ক্ষত
বিক্ষত করে , কে যেন ভগীরথের শঙ্খ বাজাতে এক রক্তের নদীর ছোঁয়ায় নিষ্প্রান পাথরের টুকরো গুলোতে জীবনের গান ছড়িয়ে যায় ।
একুশে ফেব্রুয়ারি বললে রোদেলা দুপুরে খাঁ খাঁ খোলা মাঠের সবুজ শরীরে ছিন্ন কৃষ্ণচূড়ার শব ছড়িয়ে থাকতে দেখি , কারা যেন বুক চিতিয়ে তার উপর দিয়ে ছন্দিত চরণে হেঁটে যায় । আর দুপুর গড়িয়ে বিকেল , বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় দেখি টুকটুকে লাল পাড় শাড়ির গভীরে একজোড়া আত্মমগ্ম আঁখিতারা । গলায় আঁচল; হাতে সন্ধ্যা প্রদীপের শিখা । ছোটবেলায় দেখা আমার মা । চলেছেন শান্ত গম্ভীর পায়ে , চলেছেন তুলসী তলার আলো নিয়ে ।
একুশের গন্ধ নাকে এলে আমার চোখের তারায় পলাতক যৌবনের ছায়া ভাসে । গলায় অহঙ্কারের আহ্বান ।
একুশ মনে করিয়ে দেয় নির্যাতিত এক পল্লী পণ্ডিতের কথা যিনি দেশবাসীকে ভাষা শেখাবেন বলে খণ্ড খণ্ড ‘বর্ণ পরিচয় ‘ নিয়ে গ্ৰাম থেকে গ্ৰামান্তরে ছুটে চলেছেন রোদে , জলে ।
একুশে ফেব্রুয়ারি মানে আত্মসম্মানের প্রতীক । এই আত্ম সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জন ওয়াইক্লিফ ১৩৮০ খ্রীষ্টাব্দে নিজের মুখের ভাষায় বাইবেল অনুবাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে । ১৫২২ – এ বিদ্রোহী মার্টিন লুথার সগর্বে বলতে পেরেছিলেন , ‘ রক্ত দিয়ে জীবন ধুয়ে নেবো তবু মাতৃভাষায় বাইবেল বলার দাবী ছাড়বনা । আমাদের দেশেও আত্মসম্মানের এই অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসু । ১৮৪৮ সালের ১লা জুন ডেভিড হেয়ারের স্মরণ সভায় সকলে যখন ইংরেজীতে হৃদয়াঞ্জলী দিচ্ছেন , তিনি তখন দাবি করলেন বাংলাভায় বলবেন , বললেনও ।একুশে ফেব্রুয়ারি অনেক প্রত্যয়ের ফসল । তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ১৯৫২- এর ২৬শে জানুয়ারি ঘোষনা করেন , পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ।এর প্রতিবাদে গাজিউল হকের নেতৃত্বে পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা স্থির করলেন , ৩০শে জানুয়ারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হবে । এ আন্দোলন এবার আর ছাত্র- অধ্যাপকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না । মুসলীম লীগ বাদে সব রাজনৈতিক দল একজোট হলেন এবং সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু হল ।
১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার । তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হল সর্বদলীয় ‘সর্বদলীয় ‘ রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ ‘ । এর পর ইতিহাস । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আব্দুল জব্বার , আব্দুল বরকত , সালাউদ্দিন , মানিকগঞ্জ হেমচন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রফিকউদ্দীন আহম্মদদের আত্মবলিদানে পৃথিবী জুড়ে পথ গড়ে দিয়েছে মাতৃভাষা সংরক্ষণের ।
বাহান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি এই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ইতিহাস । সেদিন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ৎযে সংগ্ৰাম শুরু হয়েছিল সেটি ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াই । এই ভাষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁরা ভাবতে পারেননি যে এই আন্দোলন একদিন বৃহৎ রূপ নিয়ে শুধু মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই শেষ হবে না একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে এবং এই সংগ্ৰাম একদিন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে ।
উনিশশো বাহান্ন আর ফিরে আসবে না , একুশে ফেব্রুয়ারি ফিরে ফিরে আসবে নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে ৎ, নতুন নতুন চেতনা নিয়ে । বাংলা ভাষা একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার ফলে রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলাভাষা যেমন আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে তেমনি রাষ্ট্রপুঞ্জ একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস রূপে ঘোষণা করে একুশের মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে ।
প্রতি বছর এই একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণ করিয়ে দেয় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ ।
একুশে তাই ইতিহাসের অর্গল খুলে দেয় , ব্যথিত স্মৃতি মুক্তি পায় সব বন্ধন থেকে , সব যন্ত্রণা থেকে । একুশে মানে ভয়কে জয় করা , বিশ্বাসের তরবারিতে ক্ষয়কে হত্যা করা । একুশের আলো কখনো নেমে না , একুশে পুরনো হয় না , মরচে পড়ে না একুশের গায়ে , মর্মে মর্মে সে বাজিয়ে যায় আনন্দ ভৈরবী সুর ।