‘দাসপুরে ক্ষুদিরাম বসুর বাল্যকাল’ —উমাশঙ্কর নিয়োগী
•মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম বসুর বাল্য ও কৈশোর মিলে বেশ কয়েকটা বছর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার হাটগেছিয়া গ্রামে কেটেছে। দাসপুর থানার পার্শ্ববর্তী কেশপুর থানার মোহবনী গ্রামে তাঁর পৈত্রিক বাড়ি। ক্ষুদিরামের বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু নাড়াজোল রাজ এস্টেটের তহশিলদার ছিলেন। কাজের সুবিধার জন্য ত্রৈলোক্যনাথ মোহবনীর বাড়িতে থাকতেন না। সপরিবারে থাকতেন মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন হবিবপুর মহল্লায় । হবিবপুরে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের সামনে চন্দ্রমোহন ত্রিবেদীর কাছ থেকে জমি কিনে একটি মাটির ঘর তৈরি করে তাতে সপরিবারে বাস
করেতন। দেশের বাড়িতে থেকে তাঁর মা বিষয় আশয় দেখাশোনা করতেন ।
ত্রৈলোক্যনাথ নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন দেশের বাড়ির সঙ্গে। মোহবনীর অদূরে কলাগ্রাম গ্রামের মেয়ে লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ত্রৈলোক্যনাথ ও লক্ষ্মীপ্রিয়ার সন্তান অপরূপা, সরোজিনী, ননীবালা ও ক্ষুদিরাম সবাই হবিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। অপরূপা বলেছেন ক্ষুদিরামের জন্ম দিনটি ছিল ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, ১২৯৬ সালের ১৯শে অগ্রহায়ণ, মঙ্গলবার। সময় সন্ধ্যে ৫টা। ললিতমোহনের মতে, সকাল ৬টা।
লক্ষ্মীপ্রিয়া ও ত্রৈলোক্যনাথের দুটি পুত্র সন্তান জন্মালেও তাদের অকাল মৃত্যু হয়। তাই সংস্কার
বশে কনিষ্ঠ সন্তান জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে মা লক্ষ্মীপ্রিয়া তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে সদ্যোজাত পুত্রকে নিজের বড় মেয়ে অপরূপাকে বিক্রি করে দেন। তাই কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখা হয় ক্ষুদিরাম।
হাটগেছিয়ার রামসদয় রায়ের পুত্র অমৃতলাল ঘাটাল দেওয়ানি আদালতের কর্মচারী। এই অমৃতলালের সঙ্গেই ক্ষুদিরামের বড়দি অপরূপার বিয়ে হয়। ক্ষুদিরামের বয়স যখন ছয় বছর তখন তাঁর মা মারা যান। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অক্টোবর লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু হয়। লক্ষ্মীপ্রিয়ার মূত্যুর কয়েক মাস পরেই ত্রৈলোক্যনাথ হাওড়া জেলার দেউল গ্রামের সুশীলাসুন্দরীকে বিয়ে করেন। বিয়ের মাস খানেক পরে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারির ত্রৈলোক্যনাথও পরলোক গমন করেন। সুশীলাসুন্দরী তাঁর বাপের বাড়িতে ফিরে যান। ইতিমধ্যে সরোজিনীরও বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। অপরূপা স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে লিখেছেন,‘তখন সরোজিনী ও আমার বিয়ে হয়ে গেছে, কেবল ননীবালার তখনও বিয়ে হয়নি, ক্ষুদিরামের বয়স তখন ছয় বছরের কিছু বেশি। এই দুইটি নাবালক তখন অনাথ ও নিরাশ্রয়।এই দুজনের যাবতীয় ভার পড়ল আমার উপর। আমরা মেদিনীপুর থেকে হাটগেছ্যা (দাশপুর) চললাম ননীবালা ও ক্ষুদিরামকে সঙ্গে নিয়ে।’
অনুমান করা যেতে পারে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের শেষের দিকে বা এপ্রিল মাসে ক্ষুদিরাম হাটগেছিয়ায় আসেন। অপরূপার বড় ছেলে ললিতমোহন ক্ষুদিরামের থেকে এক বছর কয়েক মাসের ছোট ছিলেন।দুজনের পড়াশোনার ব্যবস্থা হল রায় বাড়ি থেকে একটু দূরে অবস্থিত গিরিশ মুখোপাধ্যায়ের পাঠশালাতে।
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে ‘উঠন্ত বৃক্ষের পত্রে চেনা যায়।’ ক্ষুদিরামের ক্ষেত্রে তা সর্বৈব সত্য। অন্যান্য আর পাঁচটা পাঠশালা পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য ছেলে বেলাতেই দেখা গিয়েছিল। সর্দার পোড়ো অন্য কেউ ছিল ঠিক কিন্তু ক্ষুদিরাম ছিলেন প্রকৃত নেতা। ছেলের দল তাঁর নির্দেশ চলত। পড়াশোনাতে অনাগ্রহী ক্ষুদিরাম দুষ্ট বুদ্ধিতে সেরা ছিলেন। এর জন্য পাঠশালাতে শাস্তিও পেত হত। গুরু মশাই এর নির্দেশে পাঠশালার পড়ুয়ারা সরস্বতী পুজো উপলক্ষে নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করত। এখন যে পিচ রাস্তাটি দাসপুর থেকে সাগরপুর গিয়েছে এরই পাশে ছিল পাঠশালা। এই রাস্তা দিয়ে গোরুর গাড়ি, বরকনে গেলে তাদের কাছথেকেও ছেলেরা পয়সা চাইত। অনেকে দিত, কেউ কেউ দিত না। ক্ষুদিরামের নির্দেশে এই রকম পয়সা দিতে অনিচ্ছুক এক বরকনের পাল্কি ধরে ঝুলে পড়ে পড়ুয়ারা। বাধ্য হয় পয়সা দিতে বরকর্তা।
এক ভিক্ষুককে শীত নিবারণের জন্য ক্ষুদিরাম তাঁর পিতৃস্মৃতি শালটি দিয়েছিলেন এই হাটগেছিয়াতেই। অমৃতলালের বাস্তু সংলগ্ন একটি বড় পুকুর আছে এই পুকুরে ক্ষুদিরাম সাঁতার কাটতে শেখেন। গাছে চড়া ,রণপা চড়া ইত্যাদি এখানেই রপ্ত হন। এসব ব্যাপারে তাঁর প্রিয় সঙ্গী ছিলেন ললিতমোহন আর মঙ্গল সাঁতরা। ক্ষুদিরাম খুব ভালো বাঁশের বাঁশি বাজাতে পারতেন। বাঁশি বাজানোর হাতেখড়ি হাটগেছিয়া গ্রামেই। ললিতমোহন রায় তাঁর মামার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ক্ষুদিরাম বাঁশের বাঁশি সুন্দর বাজাইত। অবকাশ সময়ে সে বাঁশি বাজাইত, বাঁশিতে সে স্বদেশী গান গাহিত:…সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি…। কখনো বা গভীর রাত্রে বাঁশিতে গাহিত:..আয় মা করালী কালী নেচে নেচে আয় গো,/ তুই যে রক্ত খেতে ভালবাসিস্ রক্ত খেতে আয় গো।’
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষুদিরাম হাটগেছিয়াতে কাটিয়েছেন। অমৃতলাল১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তমলুক আদালতে বদলি হলে সপরিবারে তমলুক চলে যান। সঙ্গে থাকে ক্ষুদিরামও । অমৃতলাল ললিতমোহন ও ক্ষুদিরামকে তমলুক হ্যামিল্টন বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেন। ক্ষুদিরামকে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। হ্যামিল্টন বিদ্যালয়ের নথি মোতাবেক ক্ষুদিরাম চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ওই বিদ্যালয়ে পড়েছেন। দাসপুর থানার চাঁদপুর গ্রামের পুণ্যচন্দ্র সেনের ভাই গৌরীশংকর সেন ক্ষুদিরামের সমবয়সী ছিলেন। তাঁরা একই শ্রেণিতে পড়তেন। পুণ্যচন্দ্র পরে আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হন। তমলুকেই ক্ষুদিরামের সঙ্গে পুণ্যচন্দ্রের পরিচয় হয়। পরে মেদিনীপুরে তাঁর মাধ্যমে ক্ষুদিরামের সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
ক্ষুদিরামের বড়দিদি অপরূপা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই তারিখের ‘স্বাধীনতা’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকায় লিখেছেন, ‘এই তমলুকে থাকার সময় আমার বড় ছেলে ললিত ও ক্ষুদিরাম দুজনকেই ভর্তি করা হল তমলুক হ্যামিল্টন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে।’ অনুমান করা যেতে পারে ক্ষুদিরাম প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি স্থানীয় কোনও বিদ্যালয়ে পড়ে তমলুক হ্যামিল্টন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। হাটগেছিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। নিকটতম বিদ্যালয় ‘বাসুদেবপুর আদর্শ বঙ্গ বিদ্যালয়’ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাই নিজের হাতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ে ক্ষুদিরামের পড়ার কোনও নথি নেই। অদূরবর্তী সোনাখালি উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যালয়ে ক্ষুদিরামের পড়ার কোনও নথি নেই। আর স্মৃতিচারণেও কেউ এই দুটি বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেননি। হাটগেছিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি মঞ্জুরি পেলেও ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের আগে থেকে বিদ্যালয়েটি চলছিল এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এখানেই ক্ষুদিরাম ও ললিতমোহন পড়েছেন, এই সম্ভাবনা সর্বাধিক।
আদালতে সেই সময় পুজোর ছুটি লম্বা হত। প্রায় একমাস বন্ধ থাকত আদালত। এই ছুটির সময় দিদির সঙ্গে হাটগেছিয়াতে আসতেন ক্ষুদিরাম। তাঁর পাঠশালার সহপাঠীদের সঙ্গে দস্যিপনা করে দিনগুলো ভালোই কেটে যেত। বাল্যকাল থেকে ডাকাবুকো ক্ষুদিরামের বিচরণ ক্ষেত্র কেবল হাটগেছিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না আশপাশের গ্রামের রাস্তাঘাট সমস্ত ছিল তাঁর নখদর্পণে।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে অমৃতলালের কর্মক্ষেত্র হয় মেদিনীপুর সদর আদালত। তিনি ক্ষুদিরাম সহ সপরিবারে চলে এলেন মেদিনীপুর। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ক্ষুদিরাম, ললিতমোহনকে ভর্তি করে দেওয়া হল। কলেজিয়েট স্কুলের তথ্য বলছে ক্ষুদিরামকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছেন। এই স্কুলে পড়ার সময় ক্ষুদিরাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এঁদের সংস্পর্শে আসেন। বলা যায় তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ এখান থেকেই।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ। জোর কদমে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলছে। ক্ষুদিরাম স্বদেশী আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে স্কুলে যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ। মেদিনীপুর পুরানো জেল প্রাঙ্গণে কৃষিপ্রদর্শনী বসেছিল। সেখান‘সোনার বাংলা’ প্রচার পত্র বিলি করার অপরাধে ক্ষুদিরামকে হাজত বাস করতে হয়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে সরকারি নির্দেশে কৃষিকর বৃদ্ধি পায়। পাঞ্জাবের কৃষকরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। সেই আন্দোলনের আঁচ মেদিনীপুরেও লাগে। ক্ষুদিরাম যে বিপ্লবী দলের সঙ্গে সম্পূর্ণ রূপে জড়িয়ে পড়েছেন তা তাঁর দিদি জামাইবাবু বুঝতে পারেন। অমৃতলাল সপরিবারে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের পুজোর ছুটিতে দেশে-হাটগেছিয়াতে এলেন। সঙ্গে এলেন ক্ষুদিরাম। অপরূপা ভাইটিকে সংসারি করার চেষ্টা করলেন। ভেবেছিলেন, সংসারি করলে ভাইটি আর পাঁচজন সাধারণের মত জীবনের স্রোতে ফিরে আসবেন।
পাত্রীর খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন। হরতকীতলার আঠারো হাত দুর্গা নামে সুপরিচিত রাধাকৃষ্ণপুর মৌজার চক্রবর্তী বাড়ির দুর্গোৎসব, বলিহারপুরের ভট্টাচার্য বাড়ির আঠারো হাত দুর্গা পুজো, রায়দের দুর্গা পুজো খুব ধুমধাম সহকারে হত।বহুদূর দূরান্তের দর্শনার্থী আসতেন সেই সময়। অমৃতলাল রায়ের এক জ্ঞাতি কাকা অঘোরচন্দ্র রায়ের এগার বছরের শ্যালিকা বিদ্যুৎপ্রভা দিদিবাড়ি এসেছিলেন পুজো দেখতে। তাকেই দেখতে গেলেন অপরূপা ক্ষুদিরামকে সঙ্গে নিয়ে। পাত্রী পছন্দও হল। মতামত জিজ্ঞেস করলে ক্ষুদিরাম বলে বসলেন তাঁর দিদির পছন্দই তাঁর পছন্দ তবে ইংরেজ দেশ থেকে না তাড়িয়ে তিনি বিয়ে করবেন না।
বিপ্লবীদের অর্থের বড় প্রয়োজন। কপর্দকশূন্য ক্ষুদিরাম অর্থ সংগ্রহের জন্য এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিলেন। ডাক ঘাটাল সাবপোস্ট অফিস থেকে সোনাখালি যাতায়াত করে। ডাকহরকরা বিকেলে ঘাটাল থেকে ডাক আনে। অক্টোবর মাস। সূর্যাস্ত হয় পাঁচটার সময়। অনেক সময় সোনাখালি পৌঁছাতে সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। হরকরা দাসপুর থেকে হাটগেছিয়া এসে হরেকৃষ্ণপুরের পথ ধরে সোনাখালি যেত। এই পথে পড়ে সিমলা দিঘি, তার পাড় দিয়ে রাস্তা। বড় নির্জন এই রাস্তা। এখানেই একটি বট গাছের আড়ালে ক্ষুদিরাম লুকিয়ে ছিলেন । তিনি সন্ধে বেলা সরকারী ডাক লুঠ করেন। সংগৃহীত অর্থ মঙ্গল সাঁতরা মারফত মেদিনীপুর পাঠানোর ব্যবস্থা করে গভীর রাতে রণপা চড়ে গোপীগঞ্জ আসেন। এখান থেকে ভোরের স্টিমারে কোলাঘাট, সেখান থেকে ট্রেন করে মেদিনীপুর চলে যান। জীবদ্দশায় ক্ষুদিরাম আর কোন দিন হাটগেছিয়ায় ফেরেননি।
বিচারক কিংসফোর্ড। ইনি স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর খড়্গহস্ত ছিলেন। সুযোগ পেলেই কঠোর দণ্ডাদেশ দিতেন। লালবাজার পুলিশ কোর্টে ‘বন্দেমাতরম, পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার দেখতে আসা চোদ্দ বছরের সুশীল সেনকে সামান্য অপরাধে পনেরো ঘা বেত মারার নির্দেশ দেন কিংসফোর্ড। গুপ্ত সমিতির গোপন সভায় রাজা সুবোধ মল্লিক, অরবিন্দ ঘোষ, চারুচন্দ্র দত্ত কিংসফোর্ডের প্রাণদণ্ডাদেশ বহাল করেন। বিপ্লবীরা কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে পার্সেল বোমা পাঠিয়ে ব্যর্থ হন।মুজফ্ফরপুরে কিংসফোর্ডকে বদলি করা হয়। অবশেষে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কিংসফোর্ড হত্যার গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর উপর।
এই দুই বিপ্লবী মুজফ্ফরপুরে মতিঝিল এলাকায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মশালায় ওঠেন। ৩০শে এপ্রিল সন্ধে আটটার সময় কিংসফোর্ডের গাড়ি ভেবে একটি অন্য ঘোড়ার গাড়িতে ক্ষুদিরাম বোমা ছুঁড়েন। মৃত্যু হয় ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যার।পর দিন ওয়েনি গ্রামে ধরা পড়ে যান ক্ষুদিরাম। প্রফুল্ল চাকী মোকামাঘাট স্টেশনে ধরা পড়ার পূর্বে নিজের কাছে থাকা রিভলবারের গুলিতে আত্মোৎসর্গ করেন। ক্ষুদিরামের কাছ থেকে পুলিশ ২টি রিভলবার, ৩৭ রাউন্ড গুলি, ৩০ টাকা, ভারতীয় রেলের ম্যাপ ও টাইমটেবিলের একটি পাতা পেয়েছিল। মুজফ্ফরপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উডম্যানের আদালতে দ্রুত বিচার হল। বিচারক মিঃ কর্নডফ মৃত্যুদণ্ড দিলেন। ক্ষুদিরামের পক্ষে উকিল কালিদাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন, ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কুলকমল সেন প্রমুখ হাইকোর্টে আপিল করেন। বিচারপতি দ্বয় স্টেট ও রাইভ ফাঁসির আদেশই বহাল রাখেন।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই আগস্ট, মঙ্গলবার ঠিক সকাল ছটার সময় ক্ষুদিরাম মুজফ্ফরপুর জেল প্রাঙ্গণে ফাঁসিমঞ্চে মরণের ভালে জীবনের জয়টিকা এঁকে দিলেন। ফাঁসিমঞ্চের পাশে উপস্থিত ছিলেন উপেন্দ্রনাথ সেন ও ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রাণহীন দেহ দাহ করার জন্য কালিদাস বসুকে সমর্পণ করে জেল কর্তৃপক্ষ। গণ্ডক নদীর তীরে চান্দোয়াড়া ঘাটে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বিপ্লবী বীর সৈনিকের শ্মশান বন্ধু ছিলেন কালিদাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়েরা।
ছাপোষা সরকারি চাকুরে অমৃতলাল রায়ের সঙ্গে ক্ষুদিরামের সিমলা দিঘির পাড়ে ডাক লুঠের পর থেকে আর কোনও যোগাযোগ ছিল না। ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা ছিল বড়দি অপরূপাকে দেখার, তা পূর্ণ হয়নি। ফাঁসির পর মৃত দেহ নিতে অপরূপা বা তাঁর স্বামী কেউ মুজফ্ফরপুর যাননি। বড়দি অপরূপা না গেলেও ক্ষুদিরামের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কহীন এক স্নেহশীলা দিদি মেদিনীপুর থেকে গিয়ে কারা প্রাচীরের পাশে উপস্থিত ছিলেন, স্নেহের ভাইটিকে শেষ দেখা দেখতে। তিনি উকিল আব্দুল ওয়াজেদ সাহেবের সমাজ পরিত্যক্তা এক অসহায় বোন। ক্ষুদিরাম জীবন নাট্যের সেও এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্ক।
হাটগেছিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় হাটগেছিয়া ক্ষুদিরাম স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয় কিন্তু! প্রাঙ্গণে ব্যক্তি উদ্যোগে শহিদ ক্ষুদিরামের একটি আবক্ষ মৃর্তি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়। মূর্তি স্থাপনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিভূতি ভূষণ মিত্র। ১৯৪৭-১৯৬৫ কম দিন নয়! ইতিহাস সচেতন বীরেন দুয়ারীর মূল উদ্যোগে সিমলা দিঘির পাড়ে ডাক লুণ্ঠনের ঐতিহাসিক স্থলে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর শহীদস্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও ক্ষুদিরামের আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়। এখানে ক্ষুদিরামের জন্ম দিন পালন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
অমৃতলাল রায়ের অন্যান্য পুত্রেরা ললিতমোহন, কিশোরীমোহন প্রমুখ মেদিনীপুর সহ অন্যত্র বসবাস করলেও কনিষ্ঠ পুত্র আতঙ্কভঞ্জন রায় হাটগেছিয়াতে বসবাস করেছেন। আতঙ্কভঞ্জনের পুত্র বিশ্বনাথ রায় ও তাঁর স্ত্রী রিনা রায় দেখালেন, যে মাটির বাড়িতে ক্ষুদিরামের বাল্যকালের বেশ কয়েটা বছর অতিবাহিত হয়েছে সেই শতাব্দী প্রাচীন মাটির বাড়িটি। যে কক্ষটি ক্ষুদিরামের স্মৃতি বিজড়িত সেই কক্ষটি ঠাকুর ঘর হিসেবে ব্যবহার করেন। দেবদেবীর সাথে ক্ষুদিরাম, অমৃতলাল ও অপরূপার ছবিও আছে। কিন্তু এই ঐতিহাসিক স্থানে কোথাও কোন ফলক পারিবারিক, সরকারি বা সামাজিক উদ্যোগে লাগানো হয়নি । যতদূর জানা গিয়েছে ক্ষুদিরামকে সমানে রেখে সরকারি উদ্যোগে কোনও অনুষ্ঠান সিমলা দিঘির পাড়ে বা হাটগেছিয়ার স্কুল প্রাঙ্গণে এখনো পর্যন্ত হয়নি।’হাটগেছিয়া ক্ষুদিরাম স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ কেন নয় জানি না। মনে হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিশিশু শহীদ ক্ষুদিরাম বসু আমাদের কাছে ব্রাত্য বসু থেকে গিয়েছেন শহীদ ক্ষুদিরাম বসু হয়ে উঠতে পারেননি।
যাঁদের লেখা পড়েছি:•নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ক্ষুদিরাম সারা বাংলা ক্ষুদিরাম শতবার্ষিকী কমিটি’। •‘ক্ষুদিরাম’ তারাপদ সাঁতরা (রচনা সংগ্রহ প্রথম খণ্ড)। •দেবব্রত বিশ্বাসের ‘প্রেরণা ক্ষুদিরাম’। •অমলেন্দু দে’র ‘বিপ্লবী আন্দোলন ও মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ ক্ষুদিরাম’। •ভাস্করব্রত পতির ‘মুজফ্ফরপুর মনে রাখেনি’।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: •মালবিকা পাল, প্রধান শিক্ষিকা, সোনাখালি উচ্চ বিদ্যালয়, •মধুসূদন জানা,প্রধান শিক্ষক, তমলুক হ্যামিল্টন উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিশ্বনাথ রায়, হাটগেছিয়া।