দেবাশিস কুইল্যা: ঊনিশ শতকে ভারতবর্ষের নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহনের সার্থক উত্তরসূরী পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর আরদ্ধকর্মকে অগ্ৰগতির পথে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য সমাজ সংস্কারের সাথে আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের ঐকান্তিক চেষ্টায় সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন বীরসিংহের পুরুষ সিংহ।
তেজদীপ্ত এই মহামানব শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের শক্তি অর্জন করেছেন খুব ছোটবেলা থেকে নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীরচর্চার মাধ্যমে।
বিদ্যাসাগরের জীবনীকারগণ মনে করেন, বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে লেখাপড়া করা সুবোধ বালক গোপাল ও সারাদিন উৎপাত করা দুরন্ত রাখালের সমন্বয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্যকাল। এই বিষয়টি অননুমেয় নয় যে, লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় ঈশ্বরের আগ্ৰহ ছিল তার শৈশব ও কৈশোর কালের সমবয়সীদের সাথে। ঠাকুরদাসের মাটির বাড়ির পেছনে শচীবামনীর পুকুর পাড়ে সঙ্গী-সাথীদের সাথে নিয়মিত খেলাধুলা, সাঁতার কাটা শুধু নয় গাছে চড়তেও ছিলেন তিনি ওস্তাদ। খেলার মধ্যে প্রধান ছিল কাবাডি। গদাধর পাল সহ অন্যান্য বন্ধুদের সাথে কুস্তিতেও অবতীর্ণ হচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে কথাকার সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বাল্য বন্ধুদের মধ্যে দেহের আয়তন ও শক্তিতে এগিয়ে থাকা গদাধর পালকেও কুস্তিতে ধরাশায়ী করে দিতেন অনায়াসে।’
নিজের গ্ৰামের ফাঁকা জায়গায় ঈশ্বর বন্ধুদের সাথে শরীরচর্চা করতেন, সঙ্গে থাকতেন বলিষ্ঠ চেহারার ঠাকুরদা রামজয় তর্কভূষণ। ছোট্ট ঈশ্বরকে উপদেশ দিতেন, জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে শারীরিক শক্তির। দুর্বল শরীর মানসিক বৈকল্যের শিকার। ঋজু চেহারার ঠাকুরদার যোগ্য উত্তরসূরী ঈশ্বর তার অমর্যাদা করেননি। ঠাকুরদার নির্দেশমত লাঠি ঘুরিয়েছেন, ডন দিয়েছেন, কুস্তির প্যাঁচ শিখে নিয়েছেন একাগ্ৰতায়। ঈশ্বরের চরিত্রের বড় গুণ একাগ্ৰতা, দৃঢ়তা, কোমল মনোবৃত্তি অর্জন করেছিলেন খেলাধুলা ও শরীরচর্চার মাধ্যমে। আধুনিক ক্রীড়াবিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে চরিত্রের এই গুণ সৃষ্টির মূলে আছে খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রভাব।
১৮৪১ খ্রীষ্ঠাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক হওয়ার পর ছুটিতে যখন বাড়ি আসতেন, সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে খেলায় মেতে উঠতেন। সময়টা ১৮৪৪; বাড়িতে ডাকাতি হলে পরেরদিন ঘাটাল থানার ইন্সপেক্টর তদন্তে এলে কিছু উপঢৌকনের ব্যবস্থা করতে বলেন। তরুণ ঈশ্বর তাতে কর্ণপাত না করে ভাইদের সঙ্গে করে পাড়ার ছেলেদের সাথে বাড়ির অদূরে কাবাডি খেলায় মেতে উঠলেন। সাধারণ দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হলেও খেলাধুলার প্রতি আগ্ৰহ পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
পরবর্তী সময়ে সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন কঠোর নিয়মানুবর্তিতা সাথে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শারীরশিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে যুক্ত করেন। নিয়ম করে বাধ্য করেছিলেন কলেজের সবাইকে শরীরচর্চা করতে। সকলকে শরীরচর্চায় উৎসাহিত করতেন। অল্পবয়সী ছাত্রদের সাথে কাবাডি খেলতেন ও শিখিয়ে দিতেন লাঠি খেলার কৃৎকৌশল। বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী উল্লেখ করেছেন, ‘শরীরচর্চার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লাঠি খেলা, কাবাডি ও কুস্তিতে উৎসাহ ছিল। কলেজের উত্তর-পূর্ব কোণে মালির ঘরের পিছনে কুস্তির আখড়া তৈরি করেন। ছুটির পর নিজেও কুস্তিতে যোগ দিতেন। কলেজ চত্বরে থাকার সুবাদে সকালে ও বিকালে চলত ডন, বৈঠক, মুগুর ভাঁজা। তিনি কুস্তির আড়াই প্যাঁচে ছিলেন এক্কেবারে ওস্তাদ।’ বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক অধ্যাপক তথা বিদ্যাসাগরের ছাত্র কমলকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর শরীরের প্রতি বিশেষ যত্নশীল ছিলেন। প্রতিদিন কুস্তির পালোয়ান ও বিদ্যাসাগর মহাশয় পরস্পর তৈল মর্দন করতেন। শরীর গঠন ও চর্চায় ভীষণ গুরুত্ব দিতেন।’’ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া ও নিজেকে ভালবাসা; শরীরচর্চা ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে জন্মায় ।
১৮৬৬ খ্রীষ্ঠাব্দে গাড়ি উল্টে লিভারে চোট পাওয়ার পর বিদ্যাসাগর অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যান। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শত কাজের ফাঁকে সময়ে সময়ে প্রাণায়াম, শারীরিক ব্যায়াম, যোগাসন করতেন। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য যেখানেই গেছেন সেখানেও সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন শরীরচর্চার; একথা জানা যায় মহেন্দ্র লাল সরকারের স্মৃতিচারণায়। জীবনের শেষভাগে কার্মাটারে বসবাস করার সময় নিয়মিত শরীরচর্চার পাশাপাশি বাগানের মাটি কোপানো, গাছ লাগানো, কুঁয়ো থেকে জল তুলে গাছে দেওয়া; সবই করতেন নিজের হাতে। ভেবেছিলেন শারীরিক পরিশ্রমের ও শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের উপশম হবে। নিজের প্রতি বিশ্বাস ও যত্নশীল ছিলেন বলেই তিনি শরীরচর্চা ও পরিশ্রম বিমুখ ছিলেন না। এসবই সম্ভব হয়েছিল তাঁর নিয়মিত শরীরচর্চা ও খেলাধুলার জন্য ।