আমি সংঘমিত্রা দাস। ক্ষীরপাই শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ড সেন পাড়াতে বাড়ি। কলেজে পড়াশোনা করি। অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের মেয়ে আমি। গতকাল ২১ মে(২০২১) বিকেল ৫টায় আমার বাবা সুভাষচন্দ্র দাস মারা গেছেন। জানি অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি সহানুভূতি আদায় বা সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক বা শেয়ার পাওয়া জন্য লেখাটি লিখছি, তা কিন্তু নয়। আবারও বলি, আমি কারোর সহানুভূতি পাওয়ার জন্য এই পোস্ট টা করছি না। আপনাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, সবাই পুরোটা লেখাটা যেন মন দিয়ে পড়েন। আর তার সঙ্গে একটা প্রত্যাশা করব, এই পরিস্থিতিতে কেউই এমন কিছু মন্তব্য করবেন না যার ফলে আমি মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি।
সবাই এটাই জানেন যে, আমার বাবা কোরোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত ১৯ মে আমার বাবা হঠাৎ পড়ে যান এবং বুকে আঘাত পান। সেটা তখন বুঝতে পারেননি। পরের দিন ২০ মে সকালে বুকে ব্যথা অনুভব করেন এবং তাকে ক্ষীরপাই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখান থেকে কিছু ওষুধ দেওয়া এবং বুকের স্ক্যান করতে বলা হয়। কিন্তু বাবার করোনা সংক্রমণের পরীক্ষার কোনও রিপোর্ট না থাকার কারণে দুর্ভাগ্য বশত সেই মুহূর্তে স্ক্যান করানো সম্ভব হয়নি। পরের দিন অর্থাৎ গত কালকে স্ক্যান করানোর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই পরশু রাত্রে বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং বাবাকে ক্ষীরপাই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে জানা যায় বাবার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কম এবং শীঘ্রই ওনাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়।
তারপর বাবাকে ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং বার বার করে বলে দেওয়া হয় কোনও ভাবেই অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ না করা হয়। তারপর ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন যে, বাবার কী হয়েছে। আমি চিকিৎসকদের বলি, বাবার বুকে আঘাত লেগেছে, অন্য কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁরা আমার কোনও কথা শুনেই বলে দেন, বাবা করোনা সংক্রমিত। হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার সময় দীর্ঘক্ষণ বাবাকে বিনা অক্সিজেনে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কারণ হাসপাতালের দরজা এমন ভাবে আটকানো হয়েছিল যে হাসপাতাল কর্মীরা দরজা খুলতেই পারছিলেন না। তখন বাবার শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা আবার কমে যায় এবং আবার তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর অক্সিজেন দেওয়া হলেও বাবার শ্বাসকষ্ট কমছিল না। সেটা হাসপাতাল কর্মীদের বার বার জানানোর পরেও তাঁরা একবারও কাছে গিয়ে দেখেননি এবং জানারও চেষ্টা করেননি যে, বাবার কী শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। শুধু আমাদের এটাই বলা হচ্ছিল, বুকে আঘাত লাগলে ওই রকম হয়, হাসপাতালের কর্মীরা কিছু করতে পারবেন না। পরের দিন তথা ২১ মে সকালে একজন ডাক্তার আসেন। তিনি দূর থেকে বাবাকে দেখে যান। বাবার কী হয়েছিল তা আমাকে আবারও জিজ্ঞেস করা হয়। বাবার বুকে আঘাত লাগার কথাটাই তাঁদের আবারও বলি। কিন্তু আমার কথায় তাঁরা কর্ণপাত করেননি। পরন্তু এমন একটি ওষুধ আনতে বলেন, যেটা ঘাটাল শহরের কোথাও পাওয়া যায়নি। তারপর ওই হাসপাতালে আবার বাবার করোনা সংক্রমণ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা করার পর আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, বাবা করোনা সংক্রমিত নন। তাই বাবাকে এমন এক জায়গায় স্থানান্তরিত করতে হবে যেখানে করোনা সংক্রমিত নন এমন রোগীদের রাখা হয়। কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হওয়ার আগেই বাবার আবার শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হয় এবং হাসপাতাল কর্মীরা এসে বলেন , বাবা করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। মানে একবার পরীক্ষা করেই দুরকম ফলাফল।
এরপর বাবাকে কোরোনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় বাবাকে অক্সিজেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বাবা শ্বাস নিতে পারছিল না। আমি ওদেরকে সেটা বলতেই ওনারা অক্সিজেনের ব্যবস্থা না করে আমার সাথেই বচসা শুরু করে দেন। তারপর ওনারা বাবার কোনও রকম চিকিৎসা না করে শালবনী পাঠিয়ে দেন। বাবার বুকে আঘাত লাগার ফলে বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছিল সেটা আমি বার বার ওদেরকে বলার পরেও বুকে ব্যাথার কোনও চিকিৎসা করেনি। সবটা কোরোনা বলে চালিয়ে দেন এবং নিজেরা দায় এড়ানোর জন্য শালবনী পাঠিয়ে দেন। শালবনী যাওয়ার পথে বাবা শুধু একটাই কথা বলেছিল, ‘আমার বুকের স্ক্যান টা যদি একবার করা হত, ভালো হত’। তারপরেই শালবনী হাসপাতালে গাড়ি থেকে নামার সময় বাবা মাটিতে পা রাখতেই পরে যান এবং ডাক্তার বলেন ‘বাবা হার্টফেল করেছেন’। বুকে আঘাত লাগার ফলে যেই কষ্টটা হচ্ছিল সেটা আর সহ্য করতে পারলেন না।
আজ শুধুমাত্র অবহেলার কারণে বাবা আমাদের কে ছেড়ে চলে গেছে। বার বার বুকে ব্যাথার কথা বলার পরেও কেউ একবারও শোনেননি। এমনকি কোরোনা আক্রান্ত বলার কারণে বাবাকে শেষবারের মতো বাড়িতে আনতে দেওয়া হয়নি। নিজেদের সবথেকে কাছের, ভালোবাসার মানুষটিকে ওখানেই ছেড়ে আসতে হয়েছে।
বাবা মারা যাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়লাম। কিন্তু তার মানে এই নয়, সমস্ত বিষয়টি আপনাদের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে কারোর সহানুভূতি বা সাহাষ্য চাইছি। শুধু একটাই চাই, যেটা আমার বাবার সাথে হয়েছে সেটা যেন আর কারোর সাথে না হয়।
চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা, সামর্থ্য বা পরিস্থিতি কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু প্রতিবাদ তো করতেই পারি। তাই প্রতিবাদের মঞ্চ হিসাবে এই সোশ্যাল মিডিয়াকেই বেছে নিলাম।
এতটা কষ্ট পেয়ে মারা যাওয়ার পর আমার বাবা যেন পরলোকে শান্তিতে থাকতে পারেন তারই প্রার্থনা করি।
•আমাদের ফেসবুক পেজ:https://www.facebook.com/SthaniyaSambad.Ghatal/
•ইউটিউব চ্যানেল:https://www.youtube.com/SthaniyaSambad
•আমাদের সংবাদপত্রের মোবাইল অ্যাপ:https://play.google.com/store/apps/details?id=com.myghatal.eportal&hl=en
•টেলিগ্রাম চ্যানেল:https://t.me/SthaniyaSambadGhatal