‘ডিহি বলিহারপুরের চক্রবর্তীদের দধিবামন জীউ মন্দির’ —উমাশংকর নিয়োগী
•আসুন, আজ আমরা দাসপুরের অন্যতম মন্দির স্থপতি ঠাকুরদাস শীলের অক্ষয় কীর্তির অনন্য নজির ডিহি বলিহারপুরের চক্রবর্তীদের দক্ষিণমুখী পঞ্চচূড়া দধিবামন জীউর মন্দিরটি দেখতে যাব। ঘাটাল পাঁশকুড়া বাসরাস্তা ধরে দাসপুর বাসস্টপেজে নামুন ।পাঁশকুড়া স্টেসন থেকে বাসে আসতে একঘন্টা মিনিট পনের লাগবে। মুম্বাই রোড ধরে এলে মেচোগ্রামের মোড় থেকে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার হবে । দাসপুর বাসস্টপেজ থেকে থানার দিকের রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে চলুন। মিনিট পাঁচেক লাগবে না মন্দিরের কাছে যেতে । দাসপুরের পুরোনো হাটের আশেপাশে প্রায় দেড়শো ঘরের মত মন্দির শিল্পী সূত্রধরের বাস ছিল । পাড়াটি ছুতোর পাড়া নামে পরিচিত। একানেই ঠাকুরদাস শীল জীবন অতিবাহিত করেছেন । বর্তমানে মাত্র কয়েক ঘর বসবাস করেন । পুরোনো হাট ছেড়ে বাঁ দিকে গিয়ে ডানদিকের সরু কংক্রিটের রাস্তা ধরে সামান্য একটু এগোলেই এই মন্দির ।
মন্দিরে প্রবেশের দুটি দরজা । মূল দরজা দক্ষিণদিকে , অন্য দরজাটি পশ্চিমদিকে। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে মন্দিরে দেবতা প্রবেশের আগেই কোন এক কারণে মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে লেখা , “ শ্রী শ্রী জিউ দোধিবামনাসন । /সকাব্দা ১৭৬৮ সন ১২ স ৫৩ সাল /তারিক ১৫ ফা্লগুন পরিচারক শ্রীযুক্ত রাসবেহারি চক্রবোতির মোন্দির /কৃত মিস্ত্রী শ্রী ঠাকুরদাস সিল- /সাং দাসপুর ইতি – সমাপন। ” এর থেকে জানা যায় ১৭৬৮ শকাব্দে ১২৫৩ সালে অর্থাৎ ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী চক্রবর্তী মন্দির নির্মাণ করিয়েছেন । একটি লক্ষণীয় বিষয় হল , প্রতিষ্ঠালিপিটি আর পাঁচটা দাসপুরের টেরেকোটা অলংকৃত মন্দিরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক । লিপি আছে মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনের দেওয়ালে । পঙ্খ কেটে লেখা নয় , উঁচু বিটে লেখা ।
ঠাকুরদাস শীল এই মন্দিরটি তৈরি করার পর ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সুরতপুরের শীতলা মন্দিরটি নির্মাণ করেন । ত্রিখিলান বিশিষ্ট এই মন্দিরের পশ্চিম দিকের অংশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে । বেশ কিছু টেরেকোটার ফলক নেই । পশ্চিমদিকের খিলানে আপনি দেখতে পাবেন,পুতনা বধ, রামচন্দ্রের বনগমন কালে পুরনারীদের বাধা দান , রাধা সহ গোপিনীদের মথুরার বাজারে দুগ্ধজাত সামগ্রী বিক্রি করতে যাওয়া পথে দান আদায়কারী কৃষ্ণ , কৃষ্ণের বকাসুর বধ। কৃষ্ণের কংস বধ। কৃষ্ণের কংস বধের ফলক দাসপুরের অন্য কোন মন্দিরে নেই।
মধ্যের খিলানের একেবারে ডানদিকে মারীচ বধ, রাম সীতা , ভিক্ষুক রাবণ , সীতা হরণে জটায়ুর বাধা দান, রামরাবণের যুদ্ধ , রামসীতার উপস্থিতিতে লক্ষ্মণের সূর্পনখার নাসিকা ছেদন , রামচন্দ্রের বিবাহ সভা , কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ জয়ঢাক বাজানো, হাতি দিয়ে মাড়ানো , রামরাজা , ভীষ্মের শরশয্যা ; অর্জুন শরক্ষেপ করে জল তুলছেন । মহাভারতের কাহিনি দাসপুরে টেরেকোটার ফলকে খুব কম স্থান পেয়েছে। এই মন্দিরে ভীষ্মের শরশয্যা একটি অন্যতম আকর্ষণীয় ফলক। খিলানের উপরের সারিতে আছে যজ্ঞানুষ্ঠান , পাশেই বসেছে গানের আসর।
একেবারে পূর্বের খিলানে ঘণ্টা হাতে পুজারত এক ব্রাহ্মণ, পাশেই দাঁড়িয়ে নৈবেদ্যর থালা হাতে এক মহিলা। যাঁর অন্য হাতে জলের ঘটি, কন্যা সম্প্রদান, কমলে কামিনী, কেবল দশভুজা দুর্গা, মুর্তির পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় রামমোহনীয় পাগড়ি পরে একজন। রাজপদাধিকারী বলে মনে হয় । সম্ভবত ইনি রাসবিহারী চক্রবর্তী । চক্রবর্তী পরিবারে একসময়ে দুর্গা পূজা হত। একেবারে খিলানের উপরে কোন এক মহন্ত পাশে এক মহিলা । মন্দিরের আর্চে চামর হাতে চৌষট্টি যোগিনী , একই রকম মুর্তি আছে সুরতপুরের শীতলা মন্দিরে আর হরিরামপুরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরে। আর্চের সবার উপরে বংশীবদন কৃষ্ণ সহ নৃত্য ও বাদ্যরত মানুষের ফলক আছে। দশাবতারের ফলকগুলি খুলে পড়ে যাচ্ছে। অনেকে এই সব অমুল্য সম্পদ নিয়ে চলে যাচ্ছেন ।
রাসবিহারী চক্রবর্তীর বংশধর নবীন চক্রবর্তী নিকটস্থ গ্রাম দাসপুরেই থাকেন । তিনি জানালেন এই মন্দির সংস্কার করার মত আর্থিক সঙ্গতি তাঁদের নেই। তাঁদের পূর্বপুরুষদের মূল আয়ের উৎস ছিল জমি । জমির সিলিং বেঁধে দেওয়ার ফলে নামমাত্র ক্ষতি পূরণের বিনিময়ে তাঁদের অধিকাংশ জমির মালিকানা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে । ডিহি বলিহারপুরের টেরেকোটা সমৃদ্ধ এই মন্দিরটির আশু সংরক্ষণ প্রয়োজন এ বিষয়ে নবীনবাবু সহমত পোষণ করেন । সরকার এব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। রাজনৈতিক দলগুলির এ বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই। আমরা দাসপুরবাসী হিসেবে আমাদের শিল্প -সংস্কৃতির নিদর্শন স্বরূপ এই হারিয়ে যেতে বসা মন্দিরগুলিকে রক্ষা করতে নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য কোন উদ্যমী পুরুষ এগিয়ে আসুন । আমাদের সমবেত চেষ্টায় এইরকম মন্দির রক্ষা পাক ।