মন্দিরা মাজি, স্থানীয় সংবাদ, ঘাটাল: ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা হাতানোর চেষ্টা, লিঙ্কে ক্লিক করলে অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে যাওয়া, নানান ছুতোয় ওটিপি চেয়ে টাকা জালিয়াতি, লোন পাইয়ে দেওয়ার নামে বিভিন্ন মানুষদের থেকে টাকা হাতানো, এই ধরনের সাইবার ক্রাইমের ঘটনা আমাদের কারোরই অজানা নয়। ডিজিটাল যুগে বেশিরভাগ কাজই ফোনের মাধ্যমে হয়ে যায়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করতে যেমন ঝামেলা কম, সময়ও কম লাগে। তার পাশাপাশি কিন্তু প্রতি পদে পদে পাতা রয়েছে ফাঁদও। একটু ভুল
হলেই অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
সম্প্রতি ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা হাতানোর চেষ্টার ঘটনা ঘাটাল মহকুমার বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে ঘটেছে। আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেকের সঙ্গে ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রতিবার প্রতারকরা যে তাদের কাজে সফল হতে পেরেছে তা কিন্তু নয়, চেষ্টা কখনও কখনও বিফলেও গিয়েছে।
ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলেই টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাগুলি ঘটছে। ঘটনাটি হল প্রথমে কোনো আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ ব্যক্তি, আধিকারিক, পুলিশ, শিক্ষক বা ব্যবসায়ীদের নামে দুষ্কৃতীরা একটি ফেক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে। তারপর সেখান থেকে ওই ব্যক্তিদের
পরিচিত বন্ধু, আত্মীয়-পরিজন ও ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
দাসপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রোফাইলের ছবি এবং পার্সোনাল ডিটেলস মিলে যাওয়ায় প্রত্যেকেই সেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছেন। এরপরই তাঁদের সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে শুরু হয় কথোপকথন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর হসপিটালাইজের একটি ফেক ছবি পাঠিয়ে তাঁদের থেকে টাকা চাওয়া শুরু হয়। কখনও বলছে নিজে (অর্থাৎ যার প্রোফাইল থেকে মেসেজ করা হচ্ছে) হাসপাতালে ভর্তি, আবার কখনও বলা হচ্ছে তাঁর বন্ধু বা অন্য কোনও আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এইভাবে তাঁদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া হয়। সে টাকার পরিমাণ কখনও ১০ হাজার কখনও বা তার কম-বেশি। প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে অনেকেই টাকা খুইয়েছেন। আবার কেউ ফাঁদে পা দেওয়ার আগেই সচেতন হয়ে গিয়েছেন। ঘাটাল মহকুমার তিনটি থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্গা পুজোর পর থেকে এই ধরনের ঘটনার বেশ কয়েকটি করে অভিযোগ এসেছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া এই রকম কয়েকটি প্রতারণার ফাঁদের ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে। দাসপুর-১ ব্লকের হাট সরবেড়িয়া ডাঃ বি সি রায় উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শঙ্কর সরকারের নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা হাতানোর চেষ্টা চালানো হয়। শঙ্করবাবুর বাড়ি ঘাটাল থানার খড়ারে। ৭ জানুয়ারি তিনি জানতে পারেন কেউ বা কারা তাঁর নাম করে টাকা জালিয়াতির চেষ্টা চালাচ্ছে। ঘটনাটি জানার পর সত্ত্বর তিনি ঘাটাল থানায় লিখিত অভিযোগ জানান।
এই ঘটনার আগে ৪ জানুয়ারি দাসপুরের নাড়াজোলের বাসিন্দা এক শিক্ষক একইভাবে ওই ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। ওই শিক্ষকের নাম অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়। অরূপবাবুর নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জালিয়াতির সমস্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল প্রতারকেরা। তিনিও বিষয়টি পুলিশে জানিয়েছিলেন।
এই ঘটনার ঠিক এক মাস আগে অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর দাসপুরেরই রাজনগর স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক অরূপরতন মিশ্রের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছিল। অরূপবাবুর নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা হাতানোর ওই ফাঁদে তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র পা দেন এবং নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার মেসেজও পেতে থাকেন। মেসেজ পেয়ে ওই ছাত্রটি অরূপবাবুকে ফোন করে জানতে পারেন সমস্ত বিষয়টিই ফেক। আসলে এটি একটি জালিয়াতি চক্র। ঘটনাটি সম্পর্কে অরূপবাবু কিছুই জানেন না। এরপরই অরূপবাবু ঘটনার বিস্তারিত দাসপুর পুলিশে জানানোর পাশাপাশি প্রত্যেককে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করেন।
এর কয়েকদিন আগে ঘাটাল কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক গুহিরাম কিসকুর নামেও একইভাবে ফেক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। তিনি প্রথমে তাঁর এক ছাত্রের থেকে জানতে পারেন বিষয়টি। তৎক্ষণাৎ মেসেঞ্জার চ্যাটের কিছু ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে সকলকে সচেতন করেছিলেন। গুহিরামবাবুও থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন কিন্তু কোনও ফল হয়নি। তাঁর নামে খোলা ফেক অ্যাকাউন্টটি থেকে এখনও টাকা হাতানোর চক্রান্ত চলছে তাঁরই প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মেসেজ পাঠিয়ে।
ঘাটালের মহকুমা শাসক সুমন বিশ্বাস নিজেও যে এই ঘটনার শিকার হয়েছেন তা তিনি তাঁর একটি কমেন্টের মাধ্যমে জানিয়েছেন। এছাড়াও দাসপুর-১ ব্লকের জয়েন্ট বিডিও শিশির মাহালি এবং ঘাটাল থানার প্রাক্তন ওসি বিশ্বরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। তাঁরাও ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট করে প্রত্যেককে সচেতন করেন। তবে প্রতিবার প্রতারকরা তাদের কাজে সফল হতে পারেনি।
ঘাটাল মহকুমা পুলিশ আধিকারিক অগ্নিশ্বর চৌধুরী বলেন, প্রতারণার এই যুগে প্রতি পদে পদে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। টাকা দেওয়ার আগে কোথায় দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন তা অবশ্যই যাচাই করে তবেই টাকা দেবেন। পুলিশের আবেদন, তাই প্রত্যেকে সচেতন থাকুন এবং আশেপাশে কাউকে প্রতারিত হতে দেখলে তাকেও বিষয় সম্পর্কে জানিয়ে সচেতন করুন।
ফোন কলের মাধ্যমে কাউকে কোনও ব্যক্তিগত তথ্য না দেওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। কারণ, কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফোনের মাধ্যমে কোনও তথ্য জানতে চায় না।