নীল চাষকে কেন্দ্র করেই ইংরেজদের সময় ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ঘাটাল শহর। মুঘল আমলে ঘাটালের অনতিদূরে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল বাংলার শিবাজী শোভা সিংহের বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ ছিল সুবে বাংলার মুঘল শাসকের প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। এই শোভা সিংহের অধিষ্ঠিত দেবী হলেন বিশালাক্ষী। আজ ঘাটাল মহকুমার পাঠকদের জন্য শোভা সিংহের অধিষ্ঠিত এই দেবীর অনেক অজানা তথ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরলেন ঘাটাল মহকুমার এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অর্জুন পাল( WBCS)।
•প্রাচীন ইতিহাসের শহর ঘাটাল। এর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন] ঐতিহাসিক নিদর্শন। শুধু যে ব্রিটিশ শাসনকালেই এই শহর সমৃদ্ধি লাভ করেছিল তা নয়, বরং তার অনেক আগে থেকেই শিল্প, সংস্কৃতি সাহিত্যে এক উন্নত নগর ছিল আমাদের এই ঘাটাল। মূলত নীল চাষকে কেন্দ্র করেই ইংরেজদের সময় ফুলে ফেঁপে উঠেছিল এই শহর। মুঘল আমলে এই শহরের অনতিদূরে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল বাংলার শিবাজী, ঘাটালের অস্মিতা শোভা সিংহের বিদ্রোহ। আর এই শোভা সিংহের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।
ঘাটাল পৌরসভা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে এবং বীরসিংহ থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বরদা অঞ্চল। আর সেই অঞ্চলের অধিপতি শোভা সিংহ বিদ্রোহ করে বসলেন সুবে বাংলার মুঘল শাসকের প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। শোভা সিংহের বিদ্রোহের কারণ বা কি করে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এতো লোকবল জোগাড় করে ফেললেন বা তিনি বীর যোদ্ধা ছিলেন নাকি নরপিশাচ ডাকাত— সে কথা অন্য সময়ে আলোচনা করা যাবে। আপাতত তার অন্য একটি কীর্তি নিয়ে আজ আলোকপাত করবো। বরদা অঞ্চলে শোভা সিংহ এক বিশাল গড় স্থাপন করেন। এখানেই গৃহদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন মা বিশালাক্ষী। স্থানীয় ভাষায় দেবীর আরেক নাম বাঁশুরি। মা দুর্গার ১০৮টি নামের একটি হলো এই বিশালাক্ষী। শোভার গড়ের দুটি অংশ ছিল- ভিতর গড় ও বাহির গড় । এই মন্দিরটি ভিতর গড়ের কোনও এক জায়গাতে ছিল। তবে বর্তমানে এটি বাহির গড়ে ঘাটাল–চন্দ্রকোণা রাস্তার ধারে প্রতিষ্ঠিত। তবে অনেকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে এটি শোভা সিংহের আগে স্থানীয় জমিদার দলপতি সিংহের গড় ছিল। স্থানীয় অঞ্চল দলপতিপুর সেই জমিদারের সখ্য আজও বহন করে চলেছে। মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দলপতি সিংহের পতন হয়- সেই সুযোগে শোভা এই গড় দখল করে নেন। স্থানীয় লোকজন বলেন, এখানে কোনও একটি পুকুর থেকে হঠাৎই মায়ের একটি স্বর্ণ মূর্তি পাওয়া যায়। রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এখানে মায়ের একটি মৃন্ময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন রাজ পুরোহিত ক্ষমানন্দ বটব্যাল। মাতৃবিগ্রহ মৃন্ময়ী। তিনি বরদানরতা তাই সেই থেকেই স্থানটির নাম ‘বরদা’। মায়ের হাতে ধান্যশীষ আছে লৌকিকভাবে মাকে লক্ষী অর্থাৎ সম্পদাধিষ্ঠাত্রী রূপে মানা হয়। দেবীর দক্ষিণ চরণ মহাকাল ভৈরবের বক্ষে এবং বামপদ বিরূপাক্ষ ভৈরবের মস্তকে স্থাপন করে রেখেছেন। মা রক্তপীতবর্ণা, চতুর্ভুজা, নরমুণ্ডমালিনী এবং ত্রিনেত্র। মায়ের চার হাতে খড়্গ, খেতক, বরাভয় পানপাত্র এবং খরপর ধারণ করে আছেন। মায়ের মুখের দুপাশে নাগ দন্ত। উর্ধ্বদন্ত পংতির দ্বারা নিম্নোষ্ঠ দংশিত। দেবীর সাথে ময়ূরেশ্বর কার্তিক ও মুশিকবাহন গণেশ রয়েছেন। সামনে জয় বিজয়, পেছনে যোগিনী, তলায় সর্প আরও অন্যান্য দেবী এবং মা’র অনুচরবৃন্দ বিরাজমান। মায়ের বিশাল আঁখির জন্যই এখানে মায়ের নাম বিশালাক্ষী। সকাল ন’টায় দেবীর প্রথম পুজো হয়। মধ্যাহ্নে আহারের জন্য কিছুক্ষণ মন্দির বন্ধ থাকে। তারপর সন্ধ্যাবেলায় হয় সন্ধ্যারতি। পান দোক্তা মায়ের খুব প্রিয়। তাই কেউ পুজো দিতে গেলে পান দোক্তা দিতেই হয়। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো এবং পৌষ সংক্রান্তির দিনে বিশাল পুজো হয় এই মন্দিরে। দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। কিংবদন্তি অনুসারে আগে অষ্টমীর সন্ধিপুজোর সময় এখানে প্রতিবার পাশাপাশি রাখা দুটি প্রদীপের শিখা একসাথে জুড়ে যেত। তখনি বলি হতো এবং রাজার কামান দাগা হতো। এই কামানের আওয়াজ শোনার পরেই রাজত্বের অন্যত্র সন্ধিপুজো শুরু হতো। কামানের আওয়াজ এখনও হয়। ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই মন্দির থেকেই পদব্রজে শত শত অনুগামীর সাথে দূর্বাচটির মাঠে এক বিশাল জনসভা করেন।
শুধু কি মা বিশালাক্ষী মন্দির? রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে এলাকার হস্ত শিল্প, কাঁসা শিল্প ও কুটির শিল্পের বিপণির জন্য পাশেই স্থাপন করলেন নিজের স্ত্রীর নামাঙ্কিত রানীর বাজার। ব্রিটিশ আমলে এই বিপণির প্রতিপত্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কিন্তু আজও এই এলাকার পুরোনো লোকেরা শোভা সিংহকেই তাদের রাজা বলে মনে করে থাকেন।
শোভা সিংহের সুন্দরী কন্যা চন্দ্রপ্রভার সাথে বিষ্ণুপুরের রাজা রঘুনাথ সিংহের বিবাহ হয়। যৌতুকে তিনি সোনার বিশালাক্ষী মূর্তিটি পান। রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভার সাথে আসে একমাত্র লালবাঈ- যে ছিল শোভার সহযোগী ওড়িশার আফগান সর্দার রহিম খানের কন্যা। আর এই লালবাঈ চন্দ্রপ্রভার জীবনে অন্ধকার নিয়ে আসে।
রঘুনাথ সিং, লালবাঈয়ের সৌন্দর্যে মেতে ওঠেন। রাজকাজ ছেড়ে তিনি উদ্দাম ভালোবাসার মোহে কামার্ত হয়ে লালবাঈয়ের গহীনে নৌকা ভাসায়। জোছনার ধার বেয়ে যখন চুঁইয়ে পড়তো পরতে পরতে প্রেম তুফান, তখন নৌকায় মেহফিল ছিলেন লালবাঈ। লালবাঈয়ের জন্য লালবাগ নামক এক উদ্যান এবং তার মধ্যে এক প্রাসাদ তৈরি করা হয়। এদিকে চন্দ্রপ্রভা স্বামীর পা জড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘ওগো তুমি আমায় ছেড়ে যেও না, যেও না! তুমি ফিরে এসো!’ রঘুনাথ দীপ্ত কন্ঠে জানায় যে, সব কিছু ছেড়ে দিলেও, সে কখনও লালবাঈকে ছাড়তে পারবে না। এদিকে রাজ্যে তখন অনাবৃষ্টি- কিন্তু মহারাজের রাজধর্মে কোনও মন নেই। তিনি শুধুমাত্র লালবাগেই সময় কাটান। শোনা যায় রঘুনাথ নাকি লালবাঈকে বিবাহও করেন। তাঁদের মিলনে এক সন্তান জন্মগ্রহণ করে। যদিও সে নিয়ে মতভেদ আছে। রাজনীতির খেলা এখান থেকেই শুরু হয়। লালবাঈ তার পুত্রকে সিংহাসনে বসাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কথিত আছে, লালবাঈয়ের প্রভাবে রাজা নিজের সাথে রাজ্যের সমস্ত প্রজাকে মুসলিম হতে আদেশ করেন। কিন্তু যেখানে তীব্র আকর্ষণ সেখানেই বিকর্ষণ। চন্দ্রপ্রভা অপমানে প্রতিশোধ প্রিয় হয়ে ওঠে। রাজার এই রকম গর্হিত কাজে প্রজারা রানীর শরণাপন্ন হয়। নতুন মহলের ভোজনালয়ে এই ধর্মান্তরিত করার কাজ যখন চলছে , তখন রানী নিজের পুত্র গোপাল সিংহকে নিয়ে সেখানে হঠাৎ এসে উপস্থিত হন। রাজাকে লক্ষ্য করে বিষমাখানো তীর নিক্ষেপ করলে রাজার সেখানেই মৃত্যু হয়। বীর শোভা সিংহের সুযোগ্য বীরাঙ্গনা কন্যা চন্দ্রপ্রভা স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় সতী হয়ে সহমরণে গেলেন। চারদিকে চন্দ্রপ্রভা ও শোভা সিংহের নামে জয়ধ্বনি উঠলো। তারপর প্রজারা খেপে গিয়ে লালবাঈকে সেই লালবাগের জলেই ডুবিয়ে হত্যা করলো। লালবাগে ৩০ হেক্টর জলাভূমি লালবাইয়ের রক্তে লাল হয়ে গেলো। আর তখন অদূরেই বরদাতে শুরু হলো মা বিশালাক্ষীর সামনে সন্ধ্যারতি।