রবীন্দ্র কর্মকার: পরপর টানা তিন বার গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হয়ে রেকর্ড করলেন মনোহরপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান জয়দেব দোলই। ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮—টানা তিনবার পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে হ্যাট্রটিক করলেন তিনি। জয়দেববাবুর এই জনপ্রিয়তার একটাই রসায়ন, তিনি কাজ পাগল লোক। কাজ করে কীভাবে পঞ্চায়েত এলাকার উন্নয়ন করতে হয়, তা তাঁর এলাকায় গেলেই বোঝা যাবে। আর সেজন্যই তাঁকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট ভিক্ষে করতে যেতে হয়নি। এলাকার জনগণই তাঁকে অনুরোধ করে বলেছেন, জয়দেববাবু প্রধান না হলে তারা ভোট দেবেন না। জনগণই তাঁকে বারবার প্রধানের আসনে বসিয়েছেন।
ঘাটাল থানার গোপমহল গ্রামে ১৯৬৪ সালের ২ মার্চ জন্ম জয়দেব দোলইয়ের। ওই গ্রামেই বড় হওয়া। ঘাটাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। কলেজে পড়াকালীন রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। সেই সময় ঘাটালের বর্তমান বিধায়ক শঙ্কর দোলইয়ের সঙ্গে চুটিয়ে ছাত্রপরিষদ করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রতাপপুর ডিওয়াইএফআই লোকাল কমিটির গোপমহল ব্রাঞ্চের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ধীরে ধীরে রাজনীতির নেশা তাঁকে চেপে ধরে। সেই সঙ্গে হরিশপুর জলত্তোলন প্রকল্পে কাজ নিয়ে কর্মজীবনও শুরু করলেন। পরে গোপমহল অনুশীলন সমিতির নার্সারি স্কুলের শিক্ষকতার কাজ করেন বেশ কয়েক বছর। জয়দেববাবু প্রথম ভোটে দাঁড়ান সিপিএমের বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে সিপিএম বিরোধী সর্বদলীয় জোট করে ‘গ্রাম উন্নয়ন কমিটি’র ব্যানারে বটগাছ চিহ্নে ১১টি সিটের মধ্যে ১০টি সিট পেয়ে পঞ্চায়েত গঠন করেন। পাঁচ বছর দক্ষতার সঙ্গে পঞ্চায়েত পরিচালনার পর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ২০১৩ সালে ওই বটগাছ চিহ্নে আবারও ১০টি আসন পান। ওই টার্মেই তিনি সরাসরি তৃণমূলে যোগ দেন। ২০১৮ সালে তৃণমূলের হয়ে ১০টি সিট পেয়ে পরপর টানা তিনবার জয়ের হ্যাট্রিক করেন তিনি। যার দৃষ্টান্ত ঘাটাল ব্লক তো বটেই, আমাদের জেলাতেও এরকম উদাহরণ নেই বলে তিনি জানান। তবে এবারের প্রধান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলেরই একটি গোষ্ঠী তাঁর প্রধান পদের বিরোধিতা করলেও ধোপে টেকেনি।
তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে অবশ্য স্ত্রী নমিতা দোলইয়ের কোনও আপত্তি নেই। নমিতাদেবী আইসিডিএসের কর্মী। তিনি বরং মন থেকেই তাঁর রাজনীতির নেশাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। মেয়ে পারমিতা দোলই ঘাটাল কলেজের ফিলোজফি অনার্সের প্রথমবর্ষের ছাত্রী। ছেলে অর্ণব দোলই রত্নেশ্ববাটী হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র।
মনোহরপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের জনসংখ্যা প্রায় চোদ্দ হাজার। সাড়ে তিনহাজার পরিবার। এই বিপুল পরিমাণ মানুষের কাছে ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত প্রশাসক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন জয়দেববাবু। দুর্নীতিকে কখনও প্রশ্রয় দেননি বলেই জনপ্রিয়তার শিখরে থেকে তিনি টানা ৩ বার প্রধান হয়েছেন। গ্রামের উন্নয়নটাকেই একমাত্র হাতিয়ার করেই তিনি এলাকার অতিপ্রিয় ব্যক্তি হয়েছেন বলে তাঁর দাবি। গোপমহলের এক বাসিন্দা শঙ্কর মণ্ডল বলেন, জয়দেববাবু বিরোধী দলকেও সমীহের চোখে দেখেন। তাঁর পঞ্চায়েত এলাকার বিরোধী পরিবারগুলি বেশি করে সুবিধে পেয়েছে তাঁরই আমলে। এলাকায় সন্ত্রাসের নাম গন্ধ নেই।
অবসরে চাষবাস করেন। নিজস্ব ট্রাক্টর দিয়ে হাল করেন। তবে নিয়মিত পঞ্চায়েত অফিসে তাঁর যাওয়া চাইই চাই। এলাকার যার যাই সমস্যা হোক না কেন, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে সমাধান করে দেন।
পঞ্চায়েতের প্রধান বলে জয়দেববাবুর কোন ইগো নেই। জব কার্ড প্রকল্পের কাজে শ্রমিকদের কাজের কোথাও গাফিলতি থাকলে তিনি নিজেই হাতে কোদাল নিয়ে নেমে পড়েন ঠিকভাবে সেই কাজ দেখিয়ে দেবার জন্য। এধরনের ব্যাতিক্রমী প্রধান কদাচিৎ দেখা যায় না। কাউকে কখনও হিংসে করেননি। শুধু দৃঢ় প্রত্যয়ে একটাই কথা বললেন, কাজ করে দেখিয়ে দিতে পারি। তাইতো এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দারা খুব ভালবাসেন এই কাজপাগল প্রধানকে।
তাঁর আমলে সব থেকে বড় সাফল্য- তাঁর পঞ্চায়েত এলাকা থেকে চোলাই মদ ব্যবসা উচ্ছেদ। ওই পঞ্চায়েত এলাকার গোপমহল গ্রামের মালিক পাড়ায় ২৪টি পরিবার ব্রিটিশ আমল থেকে মদ ব্যবসা করেই জীবনধারণ করে আসছে। ওই মদ ব্যবসা বন্ধ করার জন্য তিনি পদক্ষেপ নিলেন। এজন্য তিনি তৈরি করেছেন প্রমীলা বাহিনী। ওই গ্রামেরই বেশ কয়েকজন মহিলাদের নেতৃত্বে প্রমীলা বাহিনী গঠন করেছেন তিনি। দুর্গা মালিক, করুণা মালিক, শোভা মালিক, অঞ্জনা মালিকদের নেতৃত্বে বেশ কিছু মহিলাদের ওই বাহিনী সদা সতর্ক ভাবে পাহারা দিচ্ছে যাতে কেউ এলাকায় মদ কেনা বেচা করতে না পারে। বর্তমান সময়ে এটা সত্যিই খুব বড় অবদান। এজন্য এলাকাবাসীরা তাঁকে সাধুবাদ দেন। যে পরিবারগুলি ওই মদ ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল, তাদের ওই ‘ব্যবসা’ বন্ধ করে দিয়ে মনোহরপুর বাজারে মাছ, মাংস প্রভৃতি দোকান করে দিয়ে তাদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে দেন জয়দেববাবু।
রাজনীতি তাঁকে মানুষের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। জনসেবা তাঁর নেশা। সেটাকে তিনি কখনই পেশা করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। সারা জীবন রাজনীতি করে যেতে চান। কারন এর মাধ্যমেই তিনি মানুষের পাশে থাকার রসদ পেয়েছেন।