১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত দাসপুরের সিংহদের ‘গোপীনাথ’ মন্দিরে টেরেকোটা —উমাশংকর নিয়োগী
•১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের পর কোন এক সময়ে দাসপুর গ্রামটি থানায় পরিণত হয়।দাসপুর এর একশো পঞ্চাশ বছর আগেও সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। বরদার জমিদার শোভা সিংহের ( ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) পত্তনিদার বঙ্গরাম চৌধুরী সহ সিংহ , নন্দী, পাল প্রমুখ পদবীধারী সোনার বেনে, গন্ধবেনে ,তাঁতি প্রভৃতি জাতি অন্যত্র থেকে এসে এখানে বসবাস করতে থাকে। ব্যবসায় সূত্রে এই পরিবারগুলো ক্রমে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠে। বলতে গেলে [✔‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]দাসপুরের শিল্প সংস্কৃতির বীজ এরাই বপন করেছিলেন । দাসপুর গ্রামের প্রতিষ্ঠা লিপি যুক্ত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গোপীনাথজীউর পূর্বমুখী একরত্ন মন্দিরটি সিংহরা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ শকব্দা ১৩৩৮ সন ১১২৩’ অর্থাৎ ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মন্দিরটি প্রতিষ্ঠালিপি সহ এখনো ( ২০২৩ খ্রিঃ ) দাঁড়িয়ে আছে । ভূস্বামী বঙ্গরাম চৌধুরীর ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত শ্যামরায়ের মন্দির কালের করাল গ্রাসে অবলুপ্ত হয়েছে। এই মন্দিরেরর কয়েকটি টেরেকোটার ফলক প্রত্নগবেষক ক্ষেত্রসমীক্ষক ত্রিপুরা বসুর সংগ্রহে যত্নে সুরক্ষিত আছে।মন্দিরটি কে বা কারা মিস্ত্রী ছিলেন তার কোন তথ্য নেই। তবে গবেষকগণ এই ফলক ও সিংহদের গোপীনাথের মন্দির সজ্জার ফলক দেখে অনুমান করেছেন , শ্যামরায়ের মন্দিরের মিস্ত্রী এবং গোপীনাথের মন্দিরের মিস্ত্রী একই ।
১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরংজেবের মৃত্যর সাথে সাথে বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হল। শাসকের দুর্বলতার সুযোগে চারিদিকে অস্থিরতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল। ভোগবিলাসব্যসনে ডুবেছিল পদাধিকারীরা । ঔরংজেব বাংলার মুর্শিদকুলি খানকে শাসন কার্যে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন । ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান বাংলার সুবাদার হলেন। দেবালয়টির টেরেকোটার ফলকে তৎকালের সমাজ ও ইতিহাসের খবর খুঁজে দেখা যেতে পারে।
সিংহদের পরিত্যক্ত মন্দিরটি দাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত । বিখ্যাত সিংহ বংশের শেষ পুরুষ হরিসাধন সিংহের কন্যা অর্চনা সিংহ দে বর্তমানে গোপীনাথজীউর সেবাইত। তাঁর তত্ত্বাবধানে পুরোন মন্দিরে গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থ প্রভৃতি গাছগুলো কেটে পরিষ্কার করার ফলে জঙ্গলের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা প্রত্নসম্পদ জনসমক্ষে চলে এসেছে। মন্দিরের প্রাচীরের মধ্যে সামনে একটি নতুন মন্দির নির্মিত হচ্ছে কিন্তু কোন সাবধানতা অবলম্বন না করায় নব নির্মিত মন্দিরের সিমেন্ট বালির ছোপ পড়ছে অমূল্য সম্পদ টেরেকোটার ফলকগুলির উপরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। । উদাসীন দাসপুরবাসী !
গোপীনাথজীউর মন্দিররে খিলান যুক্ত তিন প্রবেশদ্বারের উপর, দুটি থাম, দুই দেওয়াল গাত্র, দুটি আর্চ বর্গক্ষেত্র ও আয়তক্ষেত্রে বিধৃত টেরেকোটার ফলকে, পোড়া মাটির নক্সায় সুসজ্জিত ।ঘাটালের কর্মকারদের সিংহবাহিনীর মন্দিরে থাকা ফুলের মত অলংকরণ আছে মন্দিরের চারি দিকে। টেরেকোটা ফলকের বর্গক্ষেত্র ও আয়তক্ষেত্রগুলি ত্রিস্তরীয় । মন্দিরটিতে অগুনতি বিচিত্র নক্সা স্থান পেয়েছে। এখানে যেমন পৌরাণিক কাহিনি আছে তেমনি আছে সমাজের নানা চিত্র । মন্দিরের উপরিভাগে ও থামগুলির নিম্নাংশে পৌরাণিক কাহিনি আর নানা সামাজিক ফলক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খিলানের উপরে বেশ কতকগুলি পোড়ামাটির শিবালয় আছে। এইসব মন্দিরে থাকা শিবলিঙ্গগুলি বেলপাতার উপরে বসানো ।
খিলানের উপরে বালি সুগ্রীব লড়াই, লক্ষ্মণ ছাড়া রামের একা কুড়িহাত দশ মাথা তরবারিধারী রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ। বালি বধোদ্যত রাম , লক্ষ্মণের শক্তিশেল ,হনুমানের গন্ধমাদন আনা ছাড়াও বেশ কিছু বানর আছে খিলানের উপরে। মূল প্রবেশ দ্বারের উপর স্থান পেয়েছে কীর্তনের দল। গায়ক গায়িকা খোল বাদক ছাড়াও নৃত্যরত বেশ কয়েক জনকে দেখা যাবে। ফুলের রেণু মাখিয়ে দোল খেলার ফলক আছে এই প্রাচীনতম মন্দিরে । মন্দিরের দক্ষিণ দেয়ালের নীচে জলদস্যুদের জাহাজ , কৃষ্ণের নৌকা বিলাস ,একটি সাধারণ নৌকা ও নৌকা বিলাসের নৌকার গঠনটি লক্ষণীয়, দাসপুরের আর কোন মন্দিরে এমন নৌকা চোখে পড়েনি। একতারা হাতে বাউলের পোশাক পরা বাঊল, সংগীতের আসরে গায়ক পাশে শিশু শিক্ষার্থী, তানপুরা ,বেহালা, রুদ্রবীণা ও মৃদঙ্গ বাদক, ষড়ভুজ চৈতন্য , রাস নৃত্যরত কৃষ্ণের বহু ফলক , রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি আছে। বেশ কয়েকটি দাসপুরের সম্পুর্ণ ব্যতিক্রমী ফলক আছে এখানে । একটি ফলক ত্রিতল অট্টালিকার। জানালার পাশে বসা বেশ কয়েক জন নারী, ত্রিতলে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা দুই সম্ভ্রান্ত পুরুষের শরীর ডলাইমালাই করে দিচ্ছে দুজন। নিশ্চিন্ত অবসর যাপনের প্রতিচ্ছবি ফলকটি। একটি দশ চাকা মকরমুখী যানের উপর একটি ঘর তার মধ্যে বসে আছে কেউ একজন সামনে ও একজন পেছনে। এখন থেকে তিনশো বছর আগে দশচাকা যানের কল্পনা অভিনব বটে। রাধাকান্তপুরের গোপীনাথের মন্দিরে বেশ কয়েকটি রাজহাঁস থাকলেও দাসপুরের গোপীনাথের মন্দিরের মত এত বড় বড় রাজহাঁসের আধিক্য নেই। আর্চের সর্বোচ্চ স্তরে এদের দেখতে পাওয়া যাবে। দক্ষিণ দিকের প্রবেশ দ্বারের উপরে আক্রমণোদ্যত এক সিংহের দেখা মিলবে। সম্ভবত মন্দির প্রতিষ্ঠাতার নিজেদের বংশের প্রতীক হিসেবে সিংহটি এখানে স্থান পেয়েছে। আছে বেশ কয়েকটি টিয়াপাখি। খুব সুন্দর সুন্দর নক্সা দিয়ে মন্দিরটির কেবল সম্মুখভাগ নয়, মন্দিরের চারটি কোণও সুসজ্জিত । তিন শতাধিক বছর আগে দাসপুর এলাকায় নক্সাকাটা মাটির ঘটকলসী কেমন ছিল জানতে আপনাকে এই মন্দিরের সামনে দাঁড়ালেই হবে । মাথায় পা দিয়ে শারীরিক কসরত দেখানো বহু পুতুল দ্বারা মন্দিরের থামগুলি সুসজ্জিত।
মন্দিরের মূল প্রবেশ দ্বারের পাশেও টেরেকোটার অনেকগুলি ফলক আছে সামাটের অস্থলের মতই । জানিনা , বিশেষজ্ঞরা কী বলবেন! ভেতর দেয়ালের রঙ তিনশো বছর আগের কিনা ! এর নীল আর হলুদ রঙ এখনো দেখার মত। আমাদের দেশের নীল কেন বিশ্ববিখ্যাত ছিল দেখার জন্য এই মন্দিরের সামনে আপানাকে আসতে হবে । মন্দিরের উত্তর দিকের দরজাটি লোহার। দেবালয়কে সুরক্ষিত রাখতে দরজাটি লোহার করা হয়েছিল। দাসপুরের লোহার তথা কামাররা কত উন্নত ছিল তার নিদর্শন এই দরজাটি।রোদে জলে অবহেলার সামগ্রী হয়ে আজও মরচে ধরেনি।
শোনা যায় মেদিনীপুর জেলা চৈতন্যের পদধূলি ধন্য । সুদূর অতীতে দাসপুর চৈতন্যের প্রেমভক্তির প্লাবনে প্লাবিত হয়েছিল। একসময়ে চৈতন্য জীবনী কাব্যগুলির প্রভাবে অবতার চৈতন্যকেই কৃষ্ণ হিসাবে আরাধনা করা আরম্ভ হয়ে যায় । পরবর্তীকালে বৃন্দাবনের গোস্বামীরা পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার মাধ্যম হিসাবে চৈতন্যকে আরাধনার নির্দেশ দেন ফলে চৈতন্য পূজা কমতে থাকে । দাসপুরেও ব্যাপকভাবে একাধারে রাম, কৃষ্ণ ও চৈতন্য রূপে পূজিত হতে শুরু করেন শ্রীচৈতন্য । উপরের দুই হাতে রামের ধনুর্বাণ মধ্যের দুই হাতে কৃষ্ণের মুরলী আর নীচের দুই হাতে চৈতন্যের সন্ন্যাসের প্রতীক দণ্ড কমণ্ডুলু নিয়ে চৈতন্যের ষড়ভুজ মূর্তি । টেরেকোটা ফলকে দাসপুরের গোপীনাথ মন্দিরে ( ১৭১৬ খ্রিঃ ) , রামকৃষ্ণপুরে গোস্বামীদের বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে ( ১৭৯২ খ্রিঃ ) কোটালপুরের ভূঁইয়া দের শ্রীধর মন্দিরে ষড়ভুজ চৈতন্য ছিল বর্তমানে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ডিহিবলিহারপুর গ্রামের পাঠক গোস্বামীদের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে ( ১৭৯৮ খ্রিঃ ), আজুড়িয়ার চরণদের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে (১৮৭১ খ্রিঃ) , গোছাতির মাইতিদের রাসমঞ্চে , শ্রীধরপুরে রঘুনাথ জিউর দরজার দাঁড়ায় ও রামদাসপুরে মাইতিদের পঞ্চরত্ন দধিবামন বিষ্ণু মন্দিরে পঞ্চরত্নের মূল চূড়ায় ষড়ভুজ চৈতন্য ফলক আছে। কেবল টেরেকোটা ফলকে নয়, নিমতলার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সম্প্রদায়ের অস্থলে তিনশো বছরের বহু আগে থেকে অদ্যাবধি দারুবিগ্রহ ষড়ভুজ চৈতন্য নিত্য আরাধিত হয়ে আসছেন। নিমতলার তমাল হড় গোস্বামীর বাড়িতেও দারুবিগ্রহ ষড়ভুজ চৈতন্য দীর্ঘদিন আরাধিত হচ্ছেন।
দাসপুরের তিওরবেড়িয়ায় আছে কৃষ্ণবলরাম মন্দির, বহুনামে রাধাকৃষ্ণ মন্দির , বাসুদেবপুরে কেবল মহাপ্রভুর বিগ্রহ সহ নবরত্ন ১৮৩৩ খ্রিঃ ( অতি সম্প্রতি ধ্বংস প্রাপ্ত ) মন্দির ,জয়রামচকে মহাপ্রভুর মন্দির , বড় শিমমুলিয়ার আনন্দ আশ্রমে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার মন্দির , সাগরপুরে চাঁপীর অশ্বত্থতলার রাধামাধব মন্দির গৌরার গৌরগোপাল মন্দির সেকেন্দারীর রাধকৃষ্ণের মন্দির ইত্যাদি মন্দিরে কৃষ্ণ আরাধনার ধারাবাহিক পরিবর্তনের ইতিহাস বিধৃত আছে ।
ডঃ ত্রিপুরা বসু তাঁর ‘ সূত্রধর শিল্প দাসপুর’ গ্রন্থে দাসপুরের গোপীনাথ মন্দির সম্পর্কে লিখেছেন, “ ১৮৯৮ এর ভুমিকম্পে মন্দিরটির উত্তর ও পশ্চিম দিকের দেওয়ালে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তা দিনে দিনে ভয়াবহ হয়ে চলেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যাবে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে। ” সিংহ পরিবারের শেষ পুরুষ হরিসাধন সিংহ পরলোক গমন করার পর উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তমান সেবায়িত তাঁর কন্যা অর্চনা দে। তাঁর তত্তাবধানে গোপীনাথের পরিত্যক্ত মন্দিরের সামনে পূর্ব দিকে একটি নতুন মন্দির নির্মিত হচ্ছে ।নির্মান কর্মীদের অসতর্কতায় সিমেন্ট বালির প্রলেপ পড়ে দাসপুরের অমূল্য নিদর্শন টেরেকোটার ফলক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । মন্দিরের সামনে থাকা ডমরু আকৃতি সুপ্রাচীন তুলসীমঞ্চটির উপরে যথেচ্ছ ইট বর্ষিত হচ্ছে, জানিনা মঞ্চটির সহনশীলতা কতদুর আছে ! সরকারী উদাসীনতা উপেক্ষা করে দাসপুরের জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে এই মন্দিরটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করার জন্য পাশাপাশি উচ্চ বিদ্যালয়ের , কলেজের ইতিহাসের এবং আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের আনা যেতে পারে এইসব স্থাপত্য গুলির সামনে। এর ফলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাস সচেতনতা বাড়বে ।
Home এই মুহূর্তে ‘১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত দাসপুরের সিংহদের ‘গোপীনাথ’ মন্দিরে টেরেকোটা’ —উমাশংকর নিয়োগী