অরূপরতন মিশ্র: সনাতন ধর্মে শিব এমন এক সুমহান উচ্চতায় অধিষ্ঠিত যে তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে একটি মহাগ্রন্থ হয়ে যায়। তবু মহাশিবরাত্রির প্রাক্কালে তাঁর বিষয়ে দুচার কথা লিখে অঞ্জলি দেওয়ার বাসনা হয়েছে। তাই লিখছি।
দুঃখের কথা, এখন আমাদের পুজো মানে, আনুষ্ঠানিকতা আর হৈহল্লা। পুজো হল আরাধনা,পুজো সাধনা,আমরা মানতে চাই না। কিসের সাধনা,তার দ্বারা আমাদের চিত্তের বা জীবনের কী উন্নতি, তা ভেবে দেখি না। কিন্তু প্রত্যেকটির একটি করে গভীর তাৎপর্য আছে। ভক্তি নিষ্ঠার জন্য সে সম্বন্ধে সামান্যতম হলেও জ্ঞান প্রয়োজন। বিদ্যয়া বিন্দতে অমৃতম্…..বিদ্যাতে অমৃত লাভ হয়। এবার শিব দেবতার প্রসঙ্গে আসি।
বেদ ও শিবঃ বেদে শিব দেবতার পৃথক কোন বিশেষ মন্ত্র নেই। তবে ঋকবেদেই শিব দেবতার বীজ রোপণ হয়েছিল। তাই বৈদিক রুদ্র দেবতাই পরে পুরাণ যুগে সম্ভবতঃ শিবরূপে অধিষ্ঠিত হন। সেখানে রুদ্র দেবতার বর্ণনা আর বিশেষণ হিসেবে শিব শব্দের প্রয়োগ শিবের সঙ্গে রুদ্রের অভিন্নতাকে দৃঢ় করে।
প্রথমে সুপ্রাচীন ঋকবেদের ১ম মণ্ডলের ১১৪ সূক্তের ১ ও ৯ ঋকের উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
ইমা রুদ্রায় তবসে কপর্দিনে ক্ষয়দ্বীরায় প্রভরামহে মতীঃ।
যথা শমসদ্দ্বিপদে চতুষ্পদে বিশ্বং পুষ্টং গ্রামে অস্মিন্নাতুয়ম্।।১
অর্থঃ মহাজটাজুটধারী(কপর্দী),বীরেদেরও ভয়সৃষ্টিকারী রুদ্রকে আমরা স্তোত্র অর্পন করছি।যেন দ্বিপদ-চতুষ্পদগণ সুস্থ থাকে যেন গ্রামস্থ সকলে পুষ্ট ও রোগশূন্য হয়।
ব্যাখ্যাঃ রুদ্র বজ্র, ভয়ংকর, কিন্তু দরদীও। তাই তার কাছে চতুষ্পদ পশুদের রক্ষার ভার দেওয়া হয়েছে।পশুপতি শিব। তিনি জটাবিশিষ্ট(কপর্দী), ব্যাধি থেকে মুক্ত করেন। এ বৈশিষ্ট্যগুলি নিঃসন্দেহে পুরাণকালে প্রবাহিত হয়েছে। ৯ ঋকে দেখা যায়, ঋষি প্রার্থনা করছেনঃ ভদ্রাহি তে সুমতি মূলয়ত্তমাথা বয়মব ইতে বৃণীমহে।। অর্থঃ তোমার কৃপা অতিশয় সুখকর এবং কল্যানময়,আমরা তোমার রক্ষণ প্রার্থনা করি। এটাও শিবের চরিত্রবৈশিষ্ট্য। যজুর্বেদের আর একটি সুললিত মন্ত্রে চরিত্রবৈশিষ্ট্য ও নামবিশেষণ অনবদ্যভাবে প্রকাশ করা হয়েছেঃ
নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভাবায় চ। নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ। নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।। ৪১
মুক্তিসুখ ও সংসার সুখের দতাকে, লৌকিক ও মোক্ষসুখের কারককে, কল্যাণরূপ ও ভক্তজনের কল্যাণদাতাকে নমস্কার।। এখানে সর্বাধিক পরিচিত পৌরাণিক শিবের নামগুলি উচ্চারিত–শম্ভু, শংকর, শিব। এছাড়াও বেদের বিভিন্ন স্তোত্রে নীলগ্রীব, নীললোহিত বিশেষণগুলি সুচারুরূপে প্রয়োগ আছে। শিবের আর একটি বিশেষত্ব, তিনি ভৈষক। ঋকবেদের ৭ সূক্তে সেটাও বলা হয়েছে…..তোমার সুখপ্রদ হস্তে ভেষজ প্রস্তুত করে সকলকে সুখী করো।বৈদিক শিব রুদ্র উগ্র, ক্রোধী ও ভীষণ অথচ তিনিই সমস্ত ভুবনের অধিপতি, ভর্তা। পুরাণেও তো আমরা মহাদেব হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করেছি। এই প্রেক্ষিতে শিব দেবতাকে সম্পূর্ণ বেদ বহির্ভূত দেবতা বলা যায় না।
শিবতত্ত্বঃ ঋষিরা এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কাজকে পৃথকভাবে নির্দেশ করার জন্য তিনটি নাম অনুসরণ করেছিলেন—ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর।এই অর্থে মহেশ্বর তথা শিব সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত। শিব নিজে কালচক্র,কিন্তু কালের অধীন নন—কালকে তিনি গ্রাস করে নেন। তিনি সাংসারিক গুণ-অগুণের উর্ধ্বে—ত্রিগুণাতীত। তাঁর জন্মমৃত্যু নেই। সবকিছু ধ্বংসের পর তিনি ব্রহ্মস্বরূপে নিরাকারে মহাশক্তি হিসেবে বিন্দুবৎ বিরাজ করেন নব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
পুরাণের শিবঃ উপরোক্ত তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পুরাণের রূপক কাহিনীগুলি পল্লবিত হল। এ শিব শ্মশানে- মশানে ঘোরে, ভিক্ষে করে খায়,ছাইভস্ম গায়ে মাখে, বাঘছাল পরিধান করে, গলায় সাপ জড়িয়ে থাকে, নন্দী ভৃঙ্গী ভূত-প্রেত তার অনুচর, ইত্যাদি লৌকিক গল্প। শিব বৈরাগীর মতো ত্যাগী,কিন্তু তার আবার স্ত্রীপুত্র কন্যা নিয়ে ভরপুর মায়ার সংসার। শিবের স্ত্রীদের নাম, সতী গৌরী, পার্বতী, গঙ্গা,কালী।পুত্র ভৈরব, কার্তিক, গণেশ, কন্যা ভৈরবী, মানস কন্যা মনসা। সে বিস্তৃত আলোচনার পরিসর এখানে নেই। প্রসঙ্গান্তরে যাবো।শিব সংসারী হয়েও মুক্তির সাধক। সাধারণ মানুষের কাছে নিজের জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন, কিভাবে অহং, মোহ, মাৎসর্য ত্যাগ করে উচ্চতর জীবনাদর্শ তৈরি করা যায়। শিবচরিত্রের এক অনন্য বহুমুখী প্রকাশ দেখা যায় পুরাণের কাহিনীগুলিতে।তাঁর ছিল অসীম দৈবশক্তি। তিনি ছিলেন যোগীশ্রেষ্ঠ, চেহারা ছিলো সুঠাম,নীরোগ,ত্রিনয়নে জ্ঞানের আলো—ভোগীর মতো স্থুল নয়। তবে লৌকিক শিবের এমন রূপ দেওয়া হয়েছে।পশুদের রক্ষাকর্তা, সমাজের যাবতীয় অমঙ্গলকে কঠোরভাবে বিনাশ করেন। শিল্পকলাতে নতুনত্ব এনেছেন। নৃত্যশিল্পের তিনি অধিপতি। তবেইতো তিনি দেবাদিদেব মহাদেব,গণমানুষের আপনার জন। প্রেয় নয়, শ্রেয় বড়,এটাই শিবের শিক্ষা। আত্মজ্ঞান হলে অপরাবিদ্যাকে যথার্থ ব্যবহার করে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে মানুষ নিজেকে দেবত্বে উত্তরণ ঘটাতে পারে। শিব জগতে এটাই স্থাপন করেছেন। অজ্ঞানতার অন্ধকার সরিয়ে জ্ঞানের আলো দিয়েছেন। শিবপুজার মধ্য দিয়ে তাকেই করায়ত্ব করতে হয়।
শিবের রূপবৈচিত্র্যঃ জগৎ রক্ষায় মহেশ্বর নানারূপে নানাভাবে নানা সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন এ ধরায়। কখনও সর্বজনের শিব,কখন লিঙ্গাকারে,কখন নটরাজ,কখন মহাকাল কখন অর্ধনারীশ্বর হিসেবে দেখা দিয়েছেন। ধ্যানমন্ত্রে বলা হয়েছে, রজতগিরিসদৃশ শুভ্রোজ্জ্বল,মাথায় চন্দ্রকলা। এই চন্দ্রকলা হল চাঁদের ষোড়শ কলা–যেটি সাধারণ চোখে দেখা যায় না। তাঁর হাতে পরশু বা কুঠার অন্যায় দমনের জন্য। মৃগ তথা পশুদের বরাভয় দানকারী,প্রসন্নবদন,পদ্মাসনে অধিষ্ঠিত ব্যাঘ্রচর্মের ওপর। তিনি পঞ্চমুখ। পাঁচটি মুখের মধ্যস্থিত মুখটির নাম কল্যানসুন্দরম্, ডানদিকের শেষটি হল দক্ষিণেশ্বর,, ডানদিকের মাঝেরটি হল ঈশান,বাঁদিকের শেষ হল বামদেব, পরেরটি হল কালাগ্নি। মুখগুলি হল তাঁর জগত পালনে কোমলতা,কঠোরতা,ভীষণতা,মৃদু ভীষণতা,চরম ভয়ংকরতা চরিত্রগুনের পরিচায়ক।এরপর তাঁর জটায় গঙ্গাধারা পরবর্তীতে যুক্ত। শস্যশ্যামলা উর্বর ভূমিকে রক্ষায় তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করায়।
শিবলিঙ্গঃ লিঙ্গ শব্দটির তৎসম অর্থ হল চিহ্ন বা প্রতীক। যার সাহায্যে কোন সূক্ষ ভাবকে স্থূল বস্তুর সাহায্যে প্রকাশ করতে ব্যবহার হয়। এমন কি অন্যের থেকে পৃথক বোঝানো যায়। তাই শিবভাবকে প্রকাশের জন্য লিঙ্গ প্রতীকে পুজো করা হয়। এর তাৎপর্য খুবই গভীর। এই প্রতীকের মধ্য দিয়ে মহাজগতের সৃষ্টিচক্রকে বিধৃত করা হয়েছে।
অধ্যাত্মিকভাবে সনাতন শাস্ত্রে বিশ্বাস করা হয়, বারবার বিশ্বজগত সৃষ্টি এবং ধ্বংস হয়। মনে করা হয়, ৮৬৪ কোটি বছরে অর্থাৎ ব্রহ্মার একদিনে কল্প হয়। কল্পের শেষে সব ধ্বংস হয়। তাই এ প্রতীকের স্থাপন অংশে সৃষ্টিকে, মধ্য অংশে সৃষ্টির পর দৃশ্যমান প্রকৃতিকে এবং শীর্ষভাগে বিনাশের কর্তা হিসেবে শিবের ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়েছে।
নটরাজঃলয়কালে জগতে যে আলোড়ন, কম্পন, প্লাবন অগ্নিবিচ্ছুরণ দেখা যায় তার রূপক হল শিবের তাণ্ডব নৃত্য। সৃষ্টিকালেও এই ভয়াবহ আন্দোলন আর অগ্নিউদ্গীরণ দেখা দেয়। এটাই শিবের তাণ্ডব। তারই শিল্পরূপ নৃত্য ও মুদ্রা। একারণে এ রূপের নাম নটরাজ। কোন পুরাণে সতীর দেহত্যাগে তিনি এ নৃত্য করেছিলেন বলে বলা হয়েছে।
মহাকালঃ কালচক্রে শিবের ভূমিকার রূপ। ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করেন তিনি। তিনি তখন কালগ্রাসী। নবতর সৃষ্টির জন্য তার রুদ্ররূপ ধারণ।
অর্ধনারীশ্বরঃ লিঙ্গপুরাণ, কালিকাপুরাণ, নাথ লোকগাথা, তামিল মন্দিরগাথা ইত্যাদিতে অর্ধনারীশ্বরের পরিচয় পাওয়া যায়। কাহিনীতে বিভিন্নতা আছে। যেমন, লিঙ্গপুরাণে সৃষ্টিকালে পদ্মের ওপর ধ্যানাসনে উপবিষ্ট ব্রহ্মাকে অর্ধ নারী অর্ধ নর রূপে শিব দর্শন দিয়েছিলেন। তখন ব্রহ্মা নিজেকে দুভাগ করে নর ও নারী প্রকৃতি সৃষ্টি করেন।
নাথ লোকগাথায় বলা হলো,কয়েকজন সাধু শিবের দর্শন করতে এলে শিবের অর্ধনর ও অর্ধ নারী রূপ দেখেন এবং পুজো করেন। তামিল মন্দির গাত্রে দেখা যায়, ভৃঙ্গী অনুচর শিবকে পার্বতীবিহীন প্রদক্ষিণ করতে চাইলে পার্বতী তাকে অভিশাপ দেন। তখন শিব এ রূপ ধারণ করে সমাধা করেন। কালিকাপুরাণে আছে, গঙ্গা সম্পর্কে শিবের অনুরাগের সন্দেহে পার্বতীর অভিমান ভাঙাতে তিনি হরপার্বতী রূপ ধারণ করেন।সৃষ্টি থেকে নর ও নারীর সমগুরুত্বের কথা শিব শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
শিবরাত্রিকথাঃ শিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের চতুর্দশী তিথিতে কেন পালন করা হয় তা নিয়ে কোন কোন পুরাণে বলা হয়েছে, এই তিথিটিতে শিব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তাই বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং। আবার কেউ বলেন(কালকূট কথা), এই তিথিতে তিনি সমুদ্রমন্থনের বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হন। শিবপুরাণ মতে এটি সতীর দেহত্যাগের পর শিব-পার্বতীর বিবাহের তিথি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন মূল্যবোধ ধুলিমলিন, ভেদভাব আকীর্ণ, নিত্যসত্য অবহেলিত, রোগজর্জরিত, তখন অমরতার, অহংবর্জিত ভোগবর্জিত জ্ঞানাবতারের সাধনা ভক্তিভরে করা প্রয়োজন। তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ একান্তই আবশ্যক। হে মহাদেব, তুমি আমাদের আত্মোপলব্ধি দাও—নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতি পরমেশ্বর।।