শ্রীকান্ত পাত্র: ধর্ষণ একটা সামাজিক ব্যাধি। কালে কালে যুগে যুগে নারীর উপর জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন চালিয়ে আসছে পুরুষ। যা কিন্তু অপরাধ বলেই বিবেচিত হয়। ডারউইন তাঁর ‘ Origin of Species ‘ গ্রন্থে বলে গিয়েছেন, মানুষ তার অতীতের বন্যদশা ঘোচালেও জেনেটিকভাবে সে তার বন্যদশা বা পশুত্ব ঘোচাতে পারে নি। সুযোগ পেলেই তাই পুরুষ তার প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য অতীতের পাশবিক জীবনে ফিরে যায়। ‘ মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড বলে গিয়েছেন, আমাদের দেহ সবসময় সুখ চায়। এই সুখকে তিনি দু ভাগে ভাগ করেছেন : ধর্ষকাম ও মর্ষকম। তাই ফ্রয়েড বলেছেন, নারীর যোনি হল পুরুষের কাছে সর্বাপেক্ষা সুখদায়ক বস্তু। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, এই সুখ পাওয়ার জন্য নারীর উপর
জোর খাটিয়ে আসছে পুরুষ। সেই আদিম যুগ থেকে আজও। যখন মানুষ কিছুটা সভ্য হল তখন এই আচরণকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে শুরু করল। মহাভারতের যুগেও অকচার ধর্ষণের নজির মেলে। এমনকি যাঁদের আমরা দেব জ্ঞানে শ্রদ্ধা করি তাঁদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের তথ্য মেলে। কথা সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের ‘ ভারত প্রেমকথা ‘ পড়লেই অনেক উদহারণ পাবেন। ধর্ষনের ইতিহাস ঘাটলে আপনি আশ্চর্য হবেন কীভাবে একটি কন্যা শিশুও পুরুষের লালসার শিকার হয়। একটি নাবালিকা শিশুর ধর্ষণের খবর তো প্রায়ই সংবাদপত্রে খবর হয়। মনোবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে জীববিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্ষণকে একটি সামাজিক ব্যাধি বা অপরাধ হিসাবে গণ্য করেছেন। ভারতীয় দন্ড সংহিতায় ৩৭৫ ও ৩৭৬ নম্বর
ধারায় যৌন হয়রানি ও ধর্ষণকে অপরাধ বলে গণ্য করে দণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল মানবতার ঘৃণ্যতম অপরাধ এই ধর্ষণকে যখন সামাজিক ব্যাধি হিসাবে গণ্য করা হয়েছে তখন তা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয় কেন ? যা কিনা দৈহিক সুখ পাওয়ার একটি ক্ষেত্র হিসাবে স্বীকৃত হচ্ছে তা রাজনৈতিক সুখ পাওয়ার ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হবে কেন ? আমাদের দেশের রাজ্যের রাজনৈতিক দলের কারবারিরা ধর্ষণকে বরাবরই রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে চলেছেন কেবলমাত্র রাজনৈতিক সুখ পাওয়ার জন্য। দুটো উদাহরণ তুলে ধরা যাক। ১৯৯৩ সালের ছয় জানুয়ারি নদীয়া জেলার একটি গ্রামের কিশোরী দীপালি বসাক ধর্ষিতা হয়। পরের দিন সাত জানুয়ারি দীপালি বসাক ও তাঁর মা কল্যাণী বসাককে নিয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সোজা মহাকরনে হাজির হয়েছিলেন। সেদিন ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে যায় মহাকরনে। তাঁর অভিযোগ ছিল, সিপিএমের ছেলেরা দীপালিকে ধর্ষণ করেছে। যদিও তা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এই ধর্ষণের ঘটনা রাজনীতির শিকার হয়ে পড়লো। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৯৮ সালের মে মাসে। ভাঙ্গড়ের অস্বথবেড়িয়া গ্রামের চম্পলা সর্দার নামে এক মহিলা ধর্ষিতা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কী কান্ড ঘটিয়েছিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায় তা রাজ্যবাসী আজও মনে রেখেছেন। ২৫ মে রাজ্যজুড়ে ধৰ্মঘট ডাকা হয়। রাজ্যে ছুটে আসেন দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফারনান্ডেজ পর্যন্ত । রাজ্য রাজনীতিতে সেদিন ঝড় বয়ে যায়। দীপালি বসাক ও চম্পলা সর্দারের কী লাভ হয়েছিল তা জানা যায় নি। তাঁরা আজ কোথায় তাও জানা যায় নি। কিন্তু এই দুই কাণ্ডের নায়িকা মমতা বন্দোপাধ্যায় আজ রাজ সিংহাসনে। সিংহাসনে বসে কী এই দুই নারীর খোঁজ নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ? তাও জানা যায়নি। কিন্তু তাঁর উদ্যেশ্য সফল হয়েছিলো। একে ধর্ষণের রাজনীতি বলবেন না তো কী বলবেন ? কোনও রাজনৈতিক দলই ধর্ষণের মতো এই জঘন্য কাজকে সমর্থন করে না। যা কিনা আইন দিয়ে বা সামাজিকভাবে মোকাবিলা করা যেত তা হয়ে গেল রাজনীতির হাতিয়ার। এই ঘটনায় মুখ পুড়েছিল দুই নিরীহ মহিলার। কিন্তু মুখ উজ্জ্বল হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
এবার আসি রাজনীতির ধর্ষণ কান্ড নিয়ে। রাজনীতিকে শ্রেষ্ঠ নীতি হিসাবে বলে গিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল। তাঁর মতে, রাজনীতি হল মানব কল্যাণের নীতি। এই নীতির দ্বারা মানুষের কল্যাণ সাধিত হবে। আমাদের দেশের কৌটিল্যও ঠিক একইভাবে রাজনীতিকে মানব কল্যাণের হাতিয়ার হিসাবে বলে গিয়েছেন। দেশের রাজা বা রাজপুত্র সর্বদাই দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করবেন। একথা বলে গিয়েছেন ইতালির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলি। কিন্তু এই রাজনীতি যখন মিথ্যাচারে পরিণত হয় তখন তাকে কী বলবেন ? রাজনীতিও তখন ধর্ষিত হয়ে পড়ে না কী? শ্রেষ্ঠ নীতি তখন কলুষিত হয়ে পড়ে। হয়ে পড়ে মিথ্যাচারের রাজনীতি। একটা উদাহরণ দিই।
২০০৮ সালের ৯ এপ্রিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর দুই নম্বর ব্লকের বিডিও কল্লোল শুরের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় তারই সরকারি আবাসন থেকে। ঠিক পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে এই ঘটনা ঝড় তুলে দেয় রাজ্য রাজনীতিতে। ব্লকের ক্ষমতায় তখন সিপিএম। তৃণমূলের অভিযোগ ছিলো, সিপিএম র লোকজন বিডিও সাহেব তাঁদের কথা মতো চলেনি বলে তাঁকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে। সেদিন ছুটে এসেছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সোনাখালী হাইস্কুল মাঠের সভায় সিপিএম কে দায়ী করে সি বি আই তদন্ত দাবি করেছিলেন তিনি। রাজ্য সরকার সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুলিশ তদন্তে আর সিআইডি তদন্তে প্রমাণিত হয় বিডিও কল্লোল শুর পারিবারিক কারণে আত্মহত্যা করেছেন। মানতে চাননি তৃণমূল নেত্রী। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হয়েই কল্লোল শুর কাণ্ডে প্রাক্তন বিচারপতি গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্যর নেতৃত্বে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। সেই কমিশন পুলিশ ও সিআইডি তদন্ত কেই মান্যতা দেয়। অর্থাৎ বিডিও কল্লোল শুর পারিবারিক কারণে আত্মহত্যাই করেছেন। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণাও করেছিলেন এই রিপোর্ট (২৩ ডিসেম্বর ২০১৫)। কিন্তু যা হবার তাই হয়ে গিয়েছিল তার আগেই। ব্লকের ক্ষমতায় এসেছিলো তৃণমূল। সিপিএম গো হারান হেরেছিল। কী বলবেন এই ধরনের রাজনীতিকে ? ঠিক একইভাবে সি বি আই তদন্তে প্রমাণিত হয় কলকাতার রিজওয়ানুুর রহমান আত্মহত্যা কান্ড আর ঝাড়গ্রামের জ্ঞানেশ্বরীী রেল দুর্ঘটনা একটি নাশকতা কান্ড। ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রেম ঘটিত কারনে রিজওয়ানুুর আত্মঘাতী হয়। ঠিক একইভাবে ২০১০ সালের ২৮ মে সরডিহা ও খেমাশুলির মাঝে কুরলাগামী জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ১৭০ জন যাত্রী নিহত হন। দেড়শোর বেশি যাত্রী জখম হন। এই দুই ঘটনায়ও সিপিএমের ভুত দেখে নেচেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। পরে যা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। কী বলবেন এই দুই ঘটনাকে ? দুই ঘটনাই রাজ্য রাজনীতিতে ঝড় তুলে যায়। এই রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের বা রাজ্যের কোনও লাভ হয় নি। কোনো কল্যাণ সাধিত হয় নি। হ্যাঁ, লাভ হয়েছিলো এক জনের। তিনি মমতা বন্দোপাধ্যায়। রাজনীতি সেদিন ধর্ষিত হয়েছিল। এই ধরনের রাজনীতি করতে গিয়ে ঘাটালে মুখ থুবড়ে পড়েছে সিপিএম। গত বছর পয়লা অক্টোবর ঘাটালের বাইতিচক মাঠে এক গৃহবধূর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ তদন্তে প্রমাণিত হয় পরকীয়া সন্দহ করে প্রতিমা মল্লিক নামে ওই গৃহবধুকে খুন করেছে তাঁর স্বামী নেপাল মল্লিক। কিন্তু এই ঘটনাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা বলে রাজ্য রাজনীতি সরগরম করতে চেয়েছিল সিপিএম। সিপিএম র মুখপত্র গণশক্তি তে প্রথম পাতায় খবর পরিবেশিত হয়। কিন্তু সে খেলা জমে নি। ধর্ষিত কে হলো ? ওই মহিলা না রাজনীতি ?