ঘাটালের পড়ুয়ারা পাঠ্যপুস্তকের ‘রস’ আস্বাদন করতে শিখছে শিক্ষক গৌরাঙ্গ কর্মকারের হাত ধরে

বিশেষ প্রতিনিধি: স্কুল যে এতো মজার জায়গা হতে পারে তা ঘাটাল পশ্চিম চক্রের কনকপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা না বললে বিশ্বাস হবে না। অন্যান্য স্কুলের পড়ুয়া যেক্ষেত্রে স্কুলের ছুটির ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকে, ওই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ঠিক তার উল্টো। স্কুলে পড়াশোনার মাধ্যমেও যে বিশেষ আনন্দে মেতে থাকা যায় ওই স্কুলের পড়ুয়াদের স্কুল যাওয়ার জেদই তা বার বার প্রমাণ করে দেয়। আর সেই বিশেষ পদ্ধতিতে পঠন-পাঠন করিয়ে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে ঘাটাল ব্লকের প্রত্যন্ত এলাকার ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। দুজন শিক্ষক নিয়ে চলে স্কুলটি। পঞ্চাশের নিচে ওই স্কুলটির পড়ুয়া হলেও ওই স্কুলের পঠন-পাঠনের মান নিয়ে প্রশংসা চলে সারা ব্লকে। ঘাটাল পশ্চিম চক্রের বিদ্যালয় পরিদর্শক সৌমেন দে বলেন, আমি চক্রের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ওই স্কুলটি সম্বন্ধে শুনে খোঁজখবর নিয়েছি। বিশেষ করে ওই স্কুলের একটি শিক্ষক পড়ুয়াদের খেলা-গান ও ছড়ার মাধ্যমে মাতিয়ে শিক্ষাপ্রদান করছে। এর ফলে পড়ুয়ারাও বেশ উৎসাহিত বোধ করছে বলে জানতে পেরেছি। ওই স্কুলের টিআইসি পরিতোষ বাগও খোলামেলা ভাবেই বললেন, ওই কৃতিত্ব আমার নয়। গৌরাঙ্গ কর্মকার নামে এক ইয়াং ছেলে এই স্কুলে বছর চারেক আগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই স্কুলের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ বদলে গিয়েছে। ওই শিক্ষক শুধু আমাদের স্কুলের গর্ব নয়, এলাকারও গর্ব। একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ওই চক্রের সভাপতি তথা ইসলামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোমেশ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, গৌরাঙ্গবাবু ছড়া ও গানের মাধ্যমে এমন করে পড়ান ওই স্কুলের পড়ুয়ারা চতুর্থ শ্রেণীতেই ইংরেজি ও অংকে চোস্ত হয় যায়।
কেমন করে পড়ান গৌরাঙ্গবাবু? স্কুল গিয়ে দেখা গেল, প্রত্যেক পাঠ দানের মধ্যেই পড়ুয়াদের জন্য তিনি একটি বিশেষ পদ্ধতি তৈরি করেছেন। পদ্ধতির মধ্যে পড়ুয়ারা খুঁজে পাচ্ছে নিদারুণ মজা। ছড়া ও হাততালির মধ্যদিয়ে সব কিছু শেখানোর ব্যবস্থা করেন। শেখানোর কাজ শেষ হলে ওই বিষয়ের ওপর পড়ুয়াদের নিয়ে শুরু হয় ক্রীড়ামূলক প্রতিযোগিতা। যেমন স্কুলে গসাগু শেখানোর পরই শুরু হয় গসাগু দৌড়। স্কুলের লম্বা দুয়ারে খাতাতে ওই শিক্ষক গসাগু দিয়ে রেখে পড়ুয়াদের ছুটে গিয়ে কষে দিতে বলেন। যে আগে করবে তার জন্য থাকে পুরস্কার। স্কুলের পাশের বাসিন্দা তথা বর্তমানে ডিএলইএডের ছাত্র স্বরূপ দুয়ারী বলেন, পড়ুয়াদের সঙ্গে গৌরাঙ্গবাবুর এতই সুন্দর সম্পর্ক যার ফলে স্যার স্কুলে ঢোকার অাগেই পড়ুয়ারা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকে স্যারকে ‘ভয় দেখিয়ে’ বা হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায় তারা। তাই গৌরাঙ্গবাবুর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মন খারাপ করে। শুধু তাই নয় স্কুলে দীর্ঘ ছুটি পড়লে ‘স্যার’কে (গৌরাঙ্গবাবুকে) স্কুল এলাকায় গিয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে দেখাও করতে যেতে হয়।
এছাড়াও স্কুলে নিয়মিত অঙ্কন, নাচ, গান ও খেলাধুলার চর্চা রয়েছে। সবই করেন গৌরাঙ্গবাবু। আগে যে স্কুলের পড়ুয়ারা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ও খেলায় সে অর্থে পুরস্কার আনতে পারত না, এই কয়েক বছরেই স্কুলের বাইরে নানা প্রতিযোগিতায় পঞ্চাশের আশেপাশে পুরস্কার এসেছে। এর কারণ হিসেবে জানা গিয়েছে, গৌরাঙ্গবাবুর ২৪ ঘন্টার বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যায় শিক্ষা আর সংস্কৃতি নিয়ে। তিনি নিজে ‘প্রগতি সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। এছাড়াও সমস্ত ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি ভীতি কাটানোর জন্য একটি ইউটিউব চ্যানেলও করেেছন। সেখানে খুব সুন্দর ও সাবলীল ভাবে ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। (চ্যানেল লিঙ্ক: Ideal English Tutorial: https://www.youtube.com/channel/UCxR_YMUx9aCo2i_BuI1QRXg)
স্কুল থেকে শিলাবতী নদী পেরোলেই দাসপুর-১ ব্লকের খরদা বিষ্ণুপুরে বাড়ি। ইংরেজিতে এম.এ করার পরই ওই স্কুলে চাকরি পেয়ে যান। তিনি বলেন, চাকরি করার পরই স্কুলটাকে ভালবেসে ফেলেছি। স্কুলটাই আমার স্বপ্ন। আর পড়ুয়াদের ভালবাসি বলেই ওরা আমার কাছ থেকে খুব সহজে শিখতে পারে। আর স্কুল থেকে বেতন নিয়ে পরিবার পালন করি। তাই স্কুলটাকে আর একটি বাড়ি মনে করি। সেজন্য প্রতিদিনকার পুরস্কার কেনার জন্য পকেট থেকে টাকা ব্যয় করতে কিছুই মনে হয় না। এক অভিভাবক পবন মণ্ডল বলেন, স্কুলে এত ভালো পড়ানো হয় যার জন্য ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে আর অতিরিক্ত প্রাইভেট টিউটর দিতে হয় না।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!