তৃপ্তি পাল কর্মকার:সত্যিই কি এবার ঘাটালেও গেরুয়া ঝড় উঠেছিল? সমীক্ষা বলছে কিন্তু ‘না’। ঘাটাল মহকুমায় বিজেপির ঝড় তো দূরের কথা বিজেপির বাতাস পর্যন্ত দেয়নি। কয়েক বছর ধরে এই মহকুমার সিংহভাগ তৃণমূল নেতাদের আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ মানুষ। ফলে তাঁদের মনে ধারাবাহিক ক্ষোভ পুঞ্জিভুত হয়েছিল। সেই পুঞ্জিভুত ক্ষোভগুলো একই জায়গায় জমা হওয়ায় বিজেপি ‘আশ্চর্যজনক’ রেজাল্ট করেছে।
তৃণমূল তাদের বদনাম ঢাকতে বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে, সিপিএম, কংগ্রেস, সিপিআই-সহ সমস্ত দল বিজেপির কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তাই সমস্ত ভোট এক জায়গায় পড়েছে। এটা যে অত্যন্ত ছেঁদো কথা সেটা বুঝতে কারোরই কোনও সমস্যা হচ্ছে না। এই দেশে স্বার্থান্বেষী কাউন্সিলার, বিধায়ক এবং সাংসদদের মোটা টাকার বিনিময়ে কেনা-বেচা করা সম্ভব হলেও এত বিশাল অঙ্কের ভোটারদের টাকার বিনিময়ে একত্রিত করা সম্ভব নয়। দু’-চারজন ভোটার মদ ও মাংসের লোভে প্রভাবিত হয়ে এখানে-ওখানে ভোট দিয়ে দিলেও এত সংখ্যক ভোটারদের তা করানো কখনই সম্ভব নয়—এটা তৃণমূলও বেশ ভালো করে জানে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই সাধারণ মানুষ যে তৃণমূলকে আর সেই আবেগ দিয়ে পছন্দ করছেন না সেটা ঘাটাল মহকুমার তৃণমূল নেতৃত্ব বেশ ভালো করেই টের করতে পেয়েছিল। তাই ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাসপুর-২ ব্লক ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি ব্লকেই লাল চোখ দেখিয়ে, ব্লক অফিসে হুমকি দিয়ে, মহকুমা শাসকের অফিস তৃণমূল কর্মীদের দিয়ে ব্যারিকেট করে বিরোধীদের আটকানোর মতো পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। মহকুমার যে সব এলাকায় যত বেশি করে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল সেখানেই তৃণমূলের হার সবচাইতে বেশি হয়েছে। বিরোধীদের জোর করে মনোনয়নপত্র জমা না দিতে দেওয়ার পর ঘাটাল ব্লকের তৃণমূল নেতারা ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় অহঙ্কারের সঙ্গে বলে বেড়িয়েছিলেন, ‘আমরা যা উন্নয়ন করেছি তা দেখে এলাকার মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে কেউ আর প্রার্থী দেওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেননি।’ ২০১৯ সালে লোকসভার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ওই সব এলাকাতেই তৃণমূলের ভরাডুবি হয়েছে।
বর্তমান যুগে প্রত্যেকটি মানুষই সচেতন। আর সব কিছুরই খবর রাখেন। কোনটা আপনি মিথ্যে বলছেন আর কোনটা সত্য বলছেন—স্মার্ট ফোনের যুগে সেটা বুঝে নিতে কোনও মানুষেরই বেশিক্ষণ সময় লাগে না।
এবার আসা যাক, এই মহকুমার নেতাদের কোন কোন বিষয়গুলি সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল এবং যার প্রতিফলন ইভিএমে গিয়ে পড়েছে।
•নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মাত্রাতিরিক্ত স্ফীতি—এটি জনমানসে রাগের সবচাইতে বড় কারণ। এমনিতেই মানুষের একটা স্বভাব রয়েছে অপরের আয় সম্বন্ধে অযাচিত কৌতূহল প্রকাশ করা। কারোর যদি সরল নিয়মে অর্থনৈতির সম্পতি বাড়ে মানুষের মনে মনে সেটি খারাপ লাগলেও বাস্তবে সেটা মেনে নেন। আপনার পারিবারিক আয়ের উৎস কী সেটা এলাকার লোক খুব ভালো করে জানেন। একজন জনপ্রতিনিধি কত টাকা ভাতা পান কিম্বা একজন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী দল থেকে কী পায় সেই খোঁজও এলাকার মানুষ রাখেন। আপনার প্রতিবেশীই আপনার বাড়ির সিসি ক্যামেরা। কিন্তু আপনি সে অর্থে কিছুই করেন না সারা দিন দলের কাজ করেন অথচ দিনকে দিন আপনার অর্থনৈতিক ভোল বদলে যাচ্ছে—এটা সাধারণ মানুষের অসহ্যের কারণ। এর প্রতিবাদ যখন সরাসরি করা সম্ভব হয় না তখন তা ইভিএমে গিয়ে পড়ে।
পৌরসভা, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রামপঞ্চায়েত স্তরের বহু ঠিকাদারের অভিযোগ, স্থানীয় নেতাদের এত কাটমানি দিতে হয় যার ফলে কাজের মান ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। নেতাদের সঙ্গে অবশ্য বেশ কিছু আধিকারিকদেরও যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সেজন্য মহকুমার বেশ কিছু রাস্তা, ব্রিজ বা অন্যান্য নির্মাণ দেখলেই বুঝতে পারবেন সেগুলির মান কী রকম। নেতাদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক বাড় বাড়ন্তের কথা বলতে গেলেই তাঁরা বলবেন, হয় সোনা বিক্রি করে, না হয় শ্বশুর বাড়ি থেকে তাঁদের ওই টাকার উৎস এসেছে (প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে, লটারিতে টাকা পাওয়ার কথা কেউই বলেন না)।
•১০০ দিনের কাজের শ্রমিকদের কিম্বা আবাস যোজনার সামান্য কয়েক হাজার টাকা থেকেও স্থানীয় নেতাদের সন্তুষ্ট করতে হয়।
•ঘাটাল মহকুমায় বেশ কিছু চাকরি হয়েছে। সেই চাকরি হয় নেতার আত্মীয় পরিজন পেয়েছে কিম্বা সেই চাকরিতে প্রচুর টাকার খেলা হয়েছে। সেটা যাঁরা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন।
•চরম ঔদ্ধত্য। উন্নয়ন তো হয় জনগণের করের টাকায়। নেতারা এলাকার লাইট, রাস্তা বা ব্রিজ করে দিয়ে এমন ভাব দেখান যেন তাঁরা নিজের জমি বিক্রি করে দিয়ে ওই উন্নয়ন করে দিয়েছেন। (বরং নেতারা কখনই বিনয়ের সঙ্গে প্রকারন্তে বলেন না, এই লাইট, ড্রেন, রাস্তা বা ব্রিজটি নির্মাণ হওয়ার সৌজন্যে আমরা ঠিকাদারের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা কামানোর সুযোগ পেয়েছি।)
•প্রশাসনও চলে জনতার করের টাকায়। প্রশাসনকে এমনভাবে কাজে লাগানো হয়, যেন শাসক দল থেকেই পুলিশ প্রশাসনের কর্মীদের বেতন হয়। তাই সেই প্রশাসনকে বিরোধী দলের হয়ে কাজ করতে দেওয়া হয় না। হলেই, তাকে বদলি করে দেওয়া হয়।
•গঠনমূলক বিরোধিতা করলেই কোপে পড়তে হয়। শাসক দল যা বলবে তাই বেদবাক্য বলে মনে করতে হবে। মতের বিরোধিতা করলেই তাকে পেতে হয় নানান শাস্তি। সিংহভাগ নেতাদের রাজনৈতিক সৌজন্যতা ক্রমশ নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল।
•মনসা পুজো থেকে মেলা, তার মধ্যে যদি টাকা বা জনপ্রিয়তার গন্ধ থাকে সেখানেই নেতাদের দাদাগিরি। দলের নেতাদের তেল না দিয়ে কাজ করলেই ক্ষোভ, তাঁকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা।
এই সমস্ত ইস্যুগুলি সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেননি। সেই সঙ্গে রাজ্য স্তরের নেতাদের কিছু আচরণও তো রয়েইছে। সেজন্যই সাধারণ মানুষ যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভটি ইভিএমের মাধ্যমে মিটিয়ে নিয়েছেন।
বিজেপিকে ভালোবেসে ঘাটালের মানুষ ভোট দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন না। তা যদি হ’ত তাহলে বিজেপির জনসভাগুলিতে সাধারণ মানুষের ভিড় উপচে পড়ত। বিগত পাঁচ বছরে বলার মতো বিজেপির কাজের পরিসংখ্যানও তেমন নেই। ২০১৪ সালের অনেক প্রতিশ্রুতিই বিজেপি রাখতে পারেনি। এদিকে যেসব বুথে বিজেপি জিতেছে তার সিংহভাগ এলাকাতেই বিজেপির সে অর্থে কোনও প্রচারই ছিল না। ভোটের দিনে বুথের আশেপাশে বিজেপির কাউকে সেভাবে দেখা যায়নি। তবুও ইভিএম ভর্তি ভোট! ওই ভোট ছিল তৃণমূলের প্রতি ক্ষোভের ভোট।
আবার বলি, শাসক দল আমার পাড়ার একটি রাস্তা, জলের লাইন বা ড্রেন করে দিলে খুবই সুবিধে হয়। তার থেকে অনেক বেশি খারাপ লাগে সরকারের টাকায় কাজ করে ‘পৈতৃক টাকায়’ কাজ করার ভান দেখালে। রাজা বা জমিদারের মতো অ্যাটিচ্যুড করলে। সেজন্য এবার ভোট দেওয়ার সময় ভোটাররা শুধু একটা কথাই ভেবেছেন, কোন জায়গায় ভোট দিলে ‘এই সমস্ত নেতাদের’ বাড় বাড়ন্তকে রোখা যাবে। সেটা করতে গিয়েই পদ্মফুলকে বেছে নিয়েছেন। কারণ, ভোটারটা এটুকু ভালো করে বোঝেন, বামফ্রন্ট এখন ‘মৃতপ্রায় প্রজাতি’ আর বাকী প্রার্থীগুলিকে ভোট দেওয়া আর নোটায় দেওয়া একই।
যদি কোনও ভাবে ‘শিক্ষা’ নিয়ে এই সমস্ত নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা একটু সংযত হতে পারেন, ঠিকাদারের কাছ থেকে কামাই না করে কাজের প্রকৃত নজরদারি করা শুরু করতে পারেন এবং মানুষকে গঠনমূলক সমালোচনা করা বা প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা দিতে পারেন তাহলে ২০২১ সালের আগে তৃণমূলের ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব নয়।
কিন্তু এই প্রস্তাব ‘সোনার পাথর বাটি’র মত। কারণ, বর্তমানে সারা দেশে বেশিরভাগ মানুষই রাজনীতিতে আসেন রুজির কারণে। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে ক।নও বিনিয়োগ করতে হয় না। প্রথমের দিকে বিনিয়োগ বলতে অর্থের পরিবর্তে ‘তৈল মর্দন ও সুপারিশ’ লাগে। আর ভাগ্য ‘সুপ্রসন্ন’ হলে পেছন ফিরে তাকানোর দরকার হবে না। তা না হলে ‘দেশ সেবা’ করার জন্য কেন এত মারপিট, হানাহানি হয়? এলাকার প্রত্যেকটি নেতার অর্থনৈতিক অতীত ও বর্তমান তথ্য সংগ্রহ করুন আর মিলিয়ে নিন। যত সৌভাগ্য নেতাদের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে। এমনকী চাকুরি পাওয়ার ‘যোগ্য মেধাবী প্রার্থীরাও’ নেতাদের বা তাঁদের আত্মীয়দের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ এরাও সেবা করেন। সেই সেবার দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অশান্তির খবর কখনও শুনেছেন? কিম্বা আপনার বাড়ির সামনে যখন কেউ বিপদে পড়েন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় বা তাঁর বাড়িতে আগুন লাগলে আগুন নেভানোর সময় কে সেই সহযোগিতা করবেন (বা সেবা করবেন) তার জন্য মারপিট করতে, গণ্ডগোল করতে শুনেছেন? এসব হয় শুধু ‘দেশ সেবার’ ক্ষেত্রেই। তাই এর কারণটাও পরিষ্কার!